বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে শব্দ দূষণের মাত্রা। বিশেষ করে জনাকীর্ণ এলাকায় রেডিওমিটারে শব্দের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে ৯১ ডেসিবেল। সরকার ঘোষিত নীরব এলাকা দূষণমুক্ত রাখতেও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। যানবাহন চলাচল করে যেসমস্ত এলাকায় সেখানেতো আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি। এতে করে শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থীদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরাও নিস্তার পাচ্ছেন না শব্দ দূষণ থেকে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর গিয়াস উদ্দিন প্রায়ই দায়িত্ব পালন করেন নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায়। পাঁচ বছরের ব্যবধানে অস্বাভাবিকভাবে তার শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কমেছে।

তিনি বলেন, শুধু আমি নয়, ট্রাফিক বিভাগে যারা সড়ক-মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করেন তারা সকলেই কানে কম শুনতে পান। দৃষ্টশক্তিও দ্রুত হারান। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মধ্যে দিনের পর দিন দায়িত্ব পালন করে শারীরিক ক্ষতির মুখে আছি। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগে যারা কাজ করেন তারা এত দ্রুত শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারান না।

কলেজপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলেজিয়েট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী। উচ্চ শব্দের কারণে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঠিকভাবে লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে পারেন না। শিক্ষার্থীদের মেজাজ রুক্ষ থাকে। শিক্ষার্থীরা প্রায়ই মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হন। উচ্চশব্দ রোধে শ্রেণিকক্ষের দরজা-জানালা বন্ধ করে পাঠদান করাতে হয়।

কলেজপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাতিমা আকতার বলেন, শব্দ দূষণের কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। বিদ্যালয়ের পাশের সড়কে আন্তঃশহরে চলাচলকারী গাড়ির চালকেরা জানেন বিদ্যালয় সর্ম্পকে। কিন্তু তারা ইচ্ছেমতো উচ্চশব্দে হর্ন বাজান। অপ্রয়োজনেও হর্ন বাজিয়ে পরিবেশ নষ্ট করেন।

সরকারি পর্যবেক্ষণেও দূষণের চিত্র

বিভিন্ন এলাকার শব্দ পরিমাপ করে পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়। সর্বশেষ ৪ জুলাই নগরীর নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ৯১ ডেসিবেল। যা নির্ধারিত শব্দমাত্রার চেয়ে ২১ ডেসিবেল বেশি। সাধারণত বাস টার্মিনালে ৭০ ডেসিবেল মাত্রার অতিরিক্ত শব্দ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

জুন মাসে একই এলাকায় সর্বোচ্চ শব্দ রেকর্ড করা হয় ৭১ ডেসিবেল থেকে ৮৮ ডেসিবেল পর্যন্ত। রূপাতলী বাস টার্মিনালে ৬২ থেকে ৮৮ ডেসিবেল পর্যন্ত।

২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল ও বরিশাল ল’ কলেজ এলাকা সংরক্ষিত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। নীরব এলাকায় সর্বোচ্চ ৫০ ডেসিবেল শব্দ করা যাবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের জুন মাসের পর্যালোচনায় এসব এলাকায় ৫১ থেকে ৬৭ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ পাওয়া গেছে।

যে কারণে শব্দ দূষণ রোধ হচ্ছে না

শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ হয়ে থাকে গাড়ির ইঞ্জিন ও হর্নের ব্যবহারে। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মোটরসাইকেল থেকে বাস, ট্রাক সকল পরিবহনেই নিষিদ্ধ এই হর্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন ব্যবহৃত গাড়িও উচ্চ শব্দের কারণ।

পরিবেশ অধিদপ্তর, ট্রাফিক বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবহন চালকদের অদক্ষতা আর অসচেতনতাই শব্দ দূষণের প্রধান কারণ। সড়কের বিধিমালা অনেক চালকই জানেন না। এমনকি উচ্চমাত্রায় শব্দ করা যে অপরাধ তাও তারা জানেন না।

বরিশাল ল’ কলেজ এলাকায় অনবরত হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়া হৃদয় বলেন, এই এলাকায় হর্ন বাজানো যাবে না তা আমি আজই প্রথম জানলাম। গাড়িতে হাউড্রোলিক হর্ন লাগিয়েছি দ্রুত ও নিরাপদে চলাচল করতে। স্বাভাবিক হর্ন ব্যবহার করলে মানুষ জায়গা দেয় না।

কলেজ রোড এলাকা কথা হয় গাড়িচালক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনেক আগে শুনেছিলাম স্কুল কলেজ এলাকায় হর্ণ বাজানো উচিত না। কিন্তু এ সর্ম্পকে পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কিছুই আমাদের জানায়নি। ড্রাইভারদের নিয়ে সভা করে যদি নিয়ম-কানুনগুলো আমাদের জানাতো তাহলে আমরা হয়তো অপ্রয়োজনে হর্ন বাজাতাম না।

গাড়ির হর্ন আর ইঞ্জিনের শব্দেই শুধু নয়, উচ্চ শব্দে বক্স, জনসভায় মাইক বাজানো, আতশবাজি ফুটানো, কারখানার জেনারেটর ও নির্মাণ কাজের মেশিনে শব্দ দূষণ হয়। স্থানীয় প্রশাসন সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না করায় দিনের পর দিন দূষণের মাত্রা বাড়ছে।

বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল বলেন, হাসপাতাল সরকার ঘোষিত নীরব এলাকা হলেও সড়কে উচ্চ শব্দে গাড়ি চলাচল করে সব সময়ই। গাড়ির হর্ন অতিষ্ঠ করে তোলে। কেউই নির্দেশনা মেনে চলে না। যে কারণে আমাদের দায়িত্ব পালনেও সমস্যা হয়।

তিনি বলেন, দূষিত শব্দের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকলে মানুষের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যা বলছে কর্তৃপক্ষ

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর ১৮ (২) অনুসারে কোনো ব্যক্তি দূষণে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথমবার ১ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা। এই অপরাধ দ্বিতীয় দফায় করলে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। বিধিমালা অনুসারে বরিশালে শব্দ দূষণ রোধে উল্লেখযোগ্য আইন প্রয়োগ হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল জেলার সহকারী পরিচালক শেখ কামাল মেহেদী জানান, ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। এতে ৭৪ জন দূষণকারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের একার উদ্যোগে দূষণ রোধ করা সম্ভব না। সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি জানান, সড়কে হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় শব্দ দূষণ রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা না বাড়ালে এর ক্ষতি থেকে আমরা কেউ রক্ষা পাব না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের সিনিয়র ক্যামিস্ট গোলাম কিবরিয়া বলেন, ঘোষিত নীরব এলাকাগুলোর শব্দ আমরা নিয়মিতই পরিমাপ করি। এর একটিতেও শব্দ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না। সবগুলো স্থানে অতিরিক্ত মাত্রায় শব্দ। গাড়িগুলোতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহৃত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ খুবই খারাপ আমাদের মস্তিষ্কের জন্য। শব্দ দূষণ মানবদেহে ধীরে ধীরে শ্রবণ, মস্তিষ্ক, দৃষ্টিশক্তিসহ আরও অনেক ক্ষতি করছে। দূষণ রোধে প্রতিমাসে পরিবেশ অধিদপ্তর মোবাইল কোর্ট চালায়। কিন্তু তাতেও নিয়ন্ত্রণ হয় না।

তিনি বলেন, দূষণ রোধে জনসচেতনতাই মূল। বিশেষ করে পরিবহন শ্রমিকদের এসব নিয়ে সচেতন করতে হবে। তারা যেন অপ্রয়োজনে এবং যত্রতত্র হর্ন না বাজান, ভালো ইঞ্জিন নিয়ে সড়কে নামেন। এছাড়া আরও উচ্চ শব্দের যেসব কাজ হয় সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

আরএআর