চলতি বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে একাধিকবার বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয়েছিল ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সেটা গতকাল মঙ্গলবার থেকে বাড়িয়ে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার। ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি করে বিপৎসীমার নতুন পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। 

এতদিন তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে কেন বার বার পানি বিপৎসীমার ওপরে যাচ্ছিল। এর কারণ খুঁজে পাওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড নতুন বিপৎসীমা নির্ধারণ করেছে বলে জানা গেছে। 

তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত ডালিয়া ব্যারেজ চালু হয়েছে ১৯৯২ সালে। ডালিয়া ব্যারেজ চালুর পর থেকে বর্ষা মৌসুমে সর্ব প্রথম পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে আসছে ডালিয়া পয়েন্টে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই অবস্থা চলে আসলেও চলতি বর্ষা মৌসুমে ব্যতিক্রম ঘটেছে। তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে প্রথমে বিপৎসীমা অতিক্রম না করে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এর কারণ কী? পানি উন্নয়ন বোর্ড তা অনুসন্ধান করে মঙ্গলবার (২ জুলাই) ঢাকা থেকে হাইড্রোলজি বিভাগ ওই পয়েন্টে পানি পরিমাপের লেভেল বাড়িয়ে দেয়। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু এলাকায় কয়েকটি চর জেগেছে। চরের কারণে পানির
লেভেল ওপরে উঠে যাচ্ছে। পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলেও নদীর দুই কূল উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেনি। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরে এলে তারা ঢাকার হাউড্রোলজি বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে। অনুসন্ধান করে দেখতে পান জেগে উঠা চরের কারণে এমনটা হচ্ছে। তাই পানি পরিমাপের লেভেল বাড়িয়ে দিয়ে নতুন করে বিপৎসীমা নির্ধারণ করা হয়। 

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ। তিস্তা নদী বেষ্টিত কাউনিয়া উপজেলার গদাই এলাকার প্রায় কয়েক শতাধিক পরিবার ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া চর এলাকায় কয়েকশত পরিবারের বসতভিটা
নদীগর্ভে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। 

এ বিষয়ে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদীখনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রংপুর বিভাগের আট জেলায় গেল জুনে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ধরা হয় ৪৮৯ মিলিমিটার। কিন্তু বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭৩৫ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৪৬ মিলিমিটার বেশি।

এদিকে পাউবোর বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

সূত্র আরও জানায়, বুধবার (৩ জুলাই) দুপুর ১২টা থেকে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার নিচ এবং সকাল ৬টায় ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কাউনিয়া পয়েন্টে নতুন পরিমাপ হিসাবে বিপৎসীমা ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার ধরা হয়।

অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বুধবার দুপুর ১২টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৯টায় ৫১ দশমিক ৯৬ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৬টায় ৫১ দশমিক ৯৮ সেন্টিমিটারে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।

এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজিখেত।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ডালিয়ার পরিবর্তে কাউনিয়া পয়েন্টের পানি কেন বিপৎসীমা অতিক্রম করছে এর কারণ জানতে হাইড্রোলজি বিভাগে জানানো হয়েছিল। তারা নতুন করে বিপৎসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় বুধবার কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া ব্যারেজের সব গেট খুলে রাখা হয়েছে। এছাড়া ভাটি অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, উজানে ভারী বৃষ্টিপাত পাহাড়ি ঢলের কারণে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ভারি বন্যার আভাস পাওয়া যায়নি। তারপরও সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া আছে, যাতে বন্যায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক নদী পাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে