ভারতের উত্তর সিকিমে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুরের প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এতে নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

এছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজিক্ষেত।

পাউবো কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভাঙনকবলিত পরিবারের অনেকে নিরুপায় হয়ে বসতি সরিয়ে নিচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখাল সূর্যমূখী ক্বারী মাদরাসা, চিলাখাল মধ্যপাড়া জামে মসজিদ, উত্তর চিলাখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। এছাড়া কোলকোন্দ ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের ৫ শতাধিক ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। সেখানে নিম্নাঞ্চলে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের আলমগীর হোসেন বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরি তিস্তা নদীর পানি বাড়ে আবার কমে। হামার এত্তি ভাঙন দেখা দিছে। ঘরবাড়ি নিয়ে অনেক বিপদে আছি। এ্যালা পানির জন্তে কোনটেও যাবার পারো না। একদিকে পানি বাড়ে, আরেকদিকে আবার ভাঙতেছে। এই বানোত ঘরবাড়ি টিকবার পামো কিনা আল্লায় জানে। তিস্তা নদীর একটি শক্তিশালী বাঁধ দিলে হামার এমন অবস্থা হইল না হয়।’

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না জানান, তিস্তা নদী এলাকায় বন্যা ও ভাঙনের বিষয়ে আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি। কোথাও কোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিস্তা খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।

এদিকে পাউবোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, রংপুর জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে ৩৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়ে ১৯০ মিলিমিটার, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৩০ মিলিমিটার এবং নীলফামারীতে ৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

রোববার (৩০ জুন) সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এর আগে বিকেল ৩টায় ওই পয়েন্টে পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার, দুপুর ১২টায় ১ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ২ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৬টায় ৪ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার ধরা হয়।

অপরদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে রোববার সন্ধ্যা ৬টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক শূন্য সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে বিকেল ৩টায় ৫১ দশমিক ৯৪ সেন্টিমিটার, দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ৫১ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ৫১ দশমিক ৮৬ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৬টায় ৫১ দশমিক ৮৪ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।

সূত্র বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের উজানে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে ১৩৬ মিলিমিটার. শিলিগুড়িতে ১১৫ মিলিমিটার এবং আসামের দিব্রগড়ে ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ কারণে তিস্তার ভাটির দিকে পানি বেড়ে ক্রমশ বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় রয়েছে।

তিস্তা নদী তীরবর্তী কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে দুর্ভোগের আতঙ্ক রয়েছে। নদী তীরবর্তী আবাদি জমিগুলো তলিয়ে গিয়ে বাদাম ও শাক-সবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসল নিয়ে নদীপাড়ের মানুষ বিপাকে রয়েছে। নদীর নিম্নাঞ্চল হালকা প্লাবিত হয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ (রোববার) ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া ব্যারাজের সব গেট খুলে রাখা হয়েছে। কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ কিছুটা বাড়ছে । এছাড়া ভাটি অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর