সুনামগঞ্জে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় আট হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এ কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছেন মাছচাষিরা। বিশাল এই ক্ষতিতে বিপাকে পড়েছেন তারা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে সহযোগিতা দাবি করেছেন তারা।

জেলা সদরের মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের বুড়িস্থল গ্রাম। সেখানে চারটি পুকুরে মাছের চাষ করেন মোবারক রনি। তার বাড়ির পাশের মাছের খামার। এই খামার প্রতিষ্ঠা করতে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে ধারদেনা করেছেন, নিয়েছেন ব্যাংক ঋণও। মাছের খাবার কেনার দোকানেও রয়েছে বাকি।

বন্যায় মাছ ভেসে যাওয়ায় বেশ বিপাকে পড়েছেন তিনি। মোবারক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পানির বেগ এতো বেশি ছিল যে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার দুটি পুকুরের পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। স্রোতের ধাক্কায় পাড় ভেঙে যাওয়ায় এক রাতেই সব পুকুরে পানি ঢুকে পড়ে। চারপাশে মশারি জাল টানিয়েও মাছ আটকে রাখা যায়নি। দেনার পরিমাণ বাড়ছে। কী করবো, বুঝতে পারছি না।’

এ অবস্থা শুধু মোবারকের একার নয়, সুনামগঞ্জে এবারের বন্যার প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বহু মাছচাষি। অনেকেরই ব্যাংক থেকে ঋণসহ চক্রবৃদ্ধি সুদেও নিয়েছেন টাকা। সরকারি সহযোগিতা না পেলে এসব চাষি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন না বলে মনে করেন তারা।

একই ইউনিয়নের বুড়িস্থল এলাকায় ১০টি পুকুর নিয়ে মাহবুব আশরাফের মাছের খামার। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, বন্যার পানিতে সব কটি পুকুর প্লাবিত হয়। এ সময় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে দাবি তার।

দোয়ারাবাজার উপজেলার মনসুর মিয়ার ৮টি পুকুর। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যায় প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের উপজেলা। দেশের বাইরে থেকে একেবারে চলে আশায় শুরু করেছিলাম মাছের চাষ। এই বন্যায় আমার সব মাছ ভেসে গেছে। আমার সঞ্চয়কৃত সব টাকা এখানে বিনোয়োগ করে এখন আমি শূন্য। এখন সরকার যদি দেখে তবে হয়তো কিছুটা রক্ষা হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১২টি উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর আছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি, বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। জেলায় মাছচাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন। এবারের বন্যায় প্রায় ৮ হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমাণ ৪ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া মাছের খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ৭২ কোটি টাকার। এর মধ্যে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকার। জেলাটিতে মৎস্য সম্পদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও শান্তিগঞ্জ উপজেলায়।

শুধু যে মাছচাষিরা বিপাকে এমন নয়। তাদের সঙ্গে মাছের খাবার সরবরাহকারীরাও পড়েছেন বিপাকে। মৎস ও পোল্ট্রি খাবার সরবরাহকারী সৈয়দ নোমান। তিনি বলেন, চাষিদের কাছে টাকা পাওনার পরিমাণ অনেক। আমার প্রতিষ্ঠানেও দেখা দিয়েছে মজুদের সংকট। নতুন করে যে খাদ্য তুলবো সেই অর্থের জোগান নেই। চাষিদের কাছে আটকে আছে টাকা। তাদের ক্ষতির বিষয়টি আমি জানি। কিন্তু এতে তো আমার ব্যাবসার ক্ষতি হচ্ছে। না পারছি নতুন খাদ্য মজুদ কর‍তে, না পারছি তাদের কাছ থেকে টাকা নিতে। সব মিলিয়ে কষ্টেই আছি।

এসব বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তালিকা করেছি। ক্ষতির পরিমাণ বের করেছি। আমরা সব জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দিয়েছি। কোনো সহযোগিতা কিংবা প্রণোদনা এলে মাছচাষিরা সেটা পাবেন।

প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অসংখ্য বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট প্লাবিত হয়। এখন পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। নদী ও হাওরে পানি কমেছে।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় বন্যায় ১ হাজার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ৮ লাখ মানুষ। ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয় প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। পানি নামায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি-ঘরে ফিরছে। বন্যায় জেলা সদরের সঙ্গে কয়েকটি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখন সেগুলো স্বাভাবিক হয়েছে।

এমএএস