এক সপ্তাহে প্রায় ১০০ রাসেলস ভাইপার উদ্ধার, আতঙ্ক বাড়ছে শরীয়তপুরে
রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) সাপের আতঙ্ক সারাদেশের সঙ্গে চলছে শরীয়তপুরেও। তবে এ জেলায় আতঙ্কের মাত্রা যেন একটু বেশিই। কেননা গত দেড় মাস ধরে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও নদী-নালা থেকে প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে একাধিক বিষধর রাসেলস ভাইপার।
গত এক সপ্তাহে শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১০০টি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মেরেছে আতঙ্কিত জনতা। কেউ আবার রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করে তুলে দিয়েছেন স্নেক রেসকিউ টিমের হাতে। এভাবে প্রতিদিন রাসেলস ভাইপার সাপ ধরা পড়ায় ছোট বড় সকলের মাঝে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আতঙ্ক।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (২৬ জুন) সকাল পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ, জাজিরা ও গোসাইরহাটসহ অন্যান্য উপজেলা থেকে এসব রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার হয়েছে।
জানা যায়, বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার সাপ বিলুপ্ত ঘোষণা করার পরে ২০২০ সালের ১০ জুলাই শরীয়তপুরের পদ্মা ও মেঘনা বেষ্টিত চরাঞ্চল কাঁচিকাঁটা ইউনিয়নের মাথাভাঙা গ্রামের এক জেলের মাছ ধরার ফাঁদে সর্বপ্রথম রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পরে সাপটি স্থানীয় সাপুড়ে মিনু ঢালী সংরক্ষণ করে রাখার কয়েক দিনের মধ্যে চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্চ সেন্টার কর্তৃপক্ষ এসে সাপটি গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যায়। এরপর জেলায় কয়েক বছর রাসেলস ভাইপার সাপের দেখা না মিললেও গত দেড় মাসে সখিপুরের চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই একাধিক স্থানে দেখা মিলছে বিষধর এই সাপটির। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রকল্পের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের ২৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপ রয়েছে। সরকারি হিসেব মতে ২৭ জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপ থাকলেও উদ্ধার হওয়ার প্রাপ্ত সংখ্যার হিসেব অনুযায়ী সংখ্যার পরিমাণ একটু বেশিই যেন শরীয়তপুরে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ, জাজিরা, গোসাইরহাট ও নড়িয়া উপজেলায় রাসেলস ভাইপার সাপের দেখা মিলেছে। তবে এখন পর্যন্ত শরীয়তপুর সদর ও ডামুড্যা উপজেলায় রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রবের খবর পাওয়া যায়নি। গত এক সপ্তাহে শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১০০টি বিষধর রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮০টিরও বেশি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধারের ঘটনাস্থলসহ বিস্তারিত জানা গেছে। গত এক সপ্তাহে ভেদরগঞ্জ উপজেলায় ২৭টি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয়রা। এরমধ্যে উপজেলার বিভিন্নস্থানে ৮টিসহ সখিপুরের উত্তর ও দক্ষিণ তারাবুনিয়া এলাকায় ৫টি, চরসেনসাস এলাকায় ৪টি, চরভাগায় ৬টি, কাঁচিকাঁটায় ৩টি ও সখিপুর ইউনিয়ন এলাকা থেকে ২টি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করা হয়েছে।
জাজিরা উপজেলার বিলাশপুর ইউনিয়নের পাঁচু খার কান্দি, কুন্ডেরচর এলাকার ফসলি মাঠ, মাঝিরচর, পালেরচরের মুন্সী বাড়ি, পূর্ব নাওডোবা এলাকার পৈলান মোল্লার কান্দি এলাকা থেকে স্থানীয়রা বাচ্চাসহ ৪৯টি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মেরেছে। এ ছাড়া জব্বার আলী আকন কান্দি গ্রামের সোহেল মাদবরসহ কয়েকজন একটি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করে স্নেক রেসকিউ টিমের কাছে তুলে দিয়েছেন। গোসাইরহাট উপজেলার সিদ্দিক ঢালীর কান্দিসহ সাবেক চেয়ারম্যান শফি হাওলাদারের বাড়ির কাছে ২টি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার হয়েছে গত এক সপ্তাহে। এ ছাড়া নড়িয়া উপজেলার নড়িয়া বাজার ও ব্রিজ এলাকা থেকে গত এক সপ্তাহে ২টি রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার বসতবাড়িসহ ফসলি জমির মাঠ থেকে বিষধর সাপ উদ্ধার হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। স্থানীয় সচেতনমহল দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সমূহে অ্যান্টিভেনমসহ পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখার দাবি জানিয়েছে।
বর্তমানে রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়ে ইব্রাহিম নামে এক যুবক শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গত সোমবার (২৪ জুন) রাতে নড়িয়া ব্রিজ এলাকায় তাকে রাসেলস ভাইপার সাপে কামড় দেয়। সাপে কাঁটার পরে আতঙ্কিত না হয়ে ওঝা বা ফকিরের কাছে না গিয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে দুঃসংবাদ মুক্ত থাকা যাবে বলে দাবি সচেতন মহলের।
সখিপুর এলাকার রহুল আমিন মামুদ নামে একজন বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় দেড় মাস ধরে প্রতিদিন মানুষের বসত-বাড়ি, ফসলি মাঠ থেকে একাধিক রাসেলস ভাইপার সাপ বাচ্চাসহ উদ্ধার হচ্ছে। শরীয়তপুরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সখিপুরে রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার হওয়ার ঘটনা বেশি। এর অন্যতম কারণ পদ্মা বেষ্টিত চরাঞ্চল। প্রায় এক মাস আগেও সখিপুর বাজারের এক ব্যবসায়ীর সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে। চরাঞ্চলের মানুষ সাপে কাটলে ওঝার কাছে যায় বলেই এমন মৃত্যু হয়। সাপের কামড় থেকে রক্ষা পেতে সচেতন হয়ে চলাফেরা ও সাপে কাটলে দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা করার দাবি জানাই আমি। যেভাবে প্রতিদিন রাসেলস ভাইপার উদ্ধার হচ্ছে, এতে এলাকার ছোট-বড় সকলের আতঙ্ক বাড়ছে প্রতিদিন।
জাজিরা উপজেলার সংবাদ কর্মী আব্দুর রহিম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষের বসতবাড়ি, কৃষকের ফসলি মাঠ ও নদী-নালাসহ সকল স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে বিষধর রাসেলস ভাইপার। কয়েকদিন পরপরই জাজিরার বিভিন্ন স্থান থেকে রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করা হচ্ছে। এতে কৃষকসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। সকলের সচেতন হওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই।
সাপুড়ে মিনু ঢালী শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই ছোট বড় আকারের রাসেলস ভাইপার সাপ উদ্ধার করেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলে, প্রতিদিন রাসেলস ভাইপার অন্যান্য সাপ ধরছি। এখনো আমি সখিপুরের এক বাড়িতে সাপ ধরতে এসেছি। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।
হঠাৎ করে এভাবে রাসেলস ভাইপার সাপ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে শরীয়তপুরের বন কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপ অন্যান্য সাপের তুলনায় খুব দ্রুত সাঁতার কাটে। সাপটির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ব্যবস্থাসহ বন ও নদী নালা ধ্বংস করার কারণেই সাপটি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ এর ৬ ধারা মতে রাসেলস ভাইপার সাপ ধরা ও মেরে ফেলা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। যদি কেউ রাসেলস ভাইপার সাপ ধরে নিধন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোথাও রাসেলস ভাইপার সাপসহ অন্যান্য সাপ নিধনের খবর পেলে আমাদেরকে জানানোর অনুরোধ করছি।
পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম রয়েছে জানিয়ে শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন ডা. আবুল হাদী মোহাম্মদ শাহ পরাণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরীয়তপুরের সকল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাপে কাটার অ্যান্টিভেনম রয়েছে। রাসেলস ভাইপার সাপে কাটলে আতঙ্কিত না হয়ে ওঝা বা ফকির নয়, হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভব।
সাইফ রুদাদ/এএএ