সর্বশেষ ২০১৯ সালে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা ম‌তিউর রহমা‌ন। বাড়ি ও এলাকার খোঁজখবর মোবাইলে-মোবাইলে সারতেন। মেজো ও ছোট ভাইও গ্রামে তেমন আসতেন না। বড় ভাইয়ের ঢাকার সম্পত্তি দেখভাল করতেই ব্যস্ত থাকতেন। গ্রামের বাড়ি দেখভাল করতেন চাচাতো ভাইয়েরা।

ম‌তিউর রহমা‌নের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাজীরচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। সেখানে অবশ্য মতিউর রহমান নামে কেউ তাকে চেনেন না। চেনেন হাকিম মাস্টারের ছেলে পিন্টু নামে। মঙ্গলবার (২৫ জুন) সকাল থেকে ওই গ্রামের বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। গ্রামবাসী এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না পিন্টুর এত সম্পদ আছে। 

বাহাদুরপুর গ্রামের আব্দুল হাকিম হাওলাদারের বাড়ির অবশ্য ধরন বদলেছে। চাকচিক্য ফিরেছে। গ্রামের যে কোনো সিদ্ধান্তও পিন্টুকে জানিয়ে নেওয়া হয় বলে জানালেন প্রতিবেশী একজন। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। ঈঙ্গিত করে দেখালেন অদূরে পিন্টু সাহেবের চাচাতো ভাইদের। এগিয়ে যেতেই দেখা গেল একটি তিন তলা মাদরাসা আর দোতলা মসজিদের মাঝখানে মিনারবিশিষ্ট লম্বা তোরণের মাঝ দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ পথ। পরিচয় হয় মাহমুদ্দুন্নবীর সঙ্গে। তিনি মতিউর রহমান পিন্টুর চাচাতো ভাই। তিনি ও আরেক চাচাতো ভাই ফখরুদ্দিন এখন বাড়ির তত্ত্বাবধানে আছেন।  

মাহমুদ্দুন্নবী বলেন, বড় মিয়ার নামে যা বলা হচ্ছে এগুলো সবই ষড়যন্ত্র। তিনি এত সম্পদের মালিক না। তিনি যে সম্পদ গড়েছেন তাতে তারই পরিশ্রম বেশি ছিল। স্কুলজীবন থেকে আমরা দেখে এসেছি তিনি হিসেবি লোক। এক টাকা বেহিসেবে খরচ করতেন না। যখন স্কুলে পড়তেন তখন থেকেই ছাগল পালন করতেন। ছাগল পালতেন, বড় করতেন। সেই টাকা জমাতেনও।

তিনি জানান, প্রথম জীবনে অর্থ সংকটে ছিলেন। মুলাদীতে বাড়ি হলেও ভালো লেখাপড়ার জন্য বাবুগঞ্জের খালার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। পরিবারে তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড় মতিউর। কাজীরহাটে ভালো স্কুল না থাকায় এবং মতিউর তুখোড় মেধাবী থাকায় ভালো স্কুলে পড়াতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরিবার। মাহমুদ্দুন্নবীর ধারণা, বড় ভাইয়ের (মতিউর রহমান) বিরুদ্ধে লোক লেগেছে। 

ততক্ষণে আলোচনায় এসে যোগ দেন আরেক ভাই ফখরুদ্দিন। তিনি জানান, মসজিদ-মাদরাসা দেখাশোনা করেই তিনি বেশ আছেন। বাকি জীবন এভাবে কাটাতে চান। 

তার চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি বলেন, আমরাতো তার বংশের। এত টাকাই যদি তার থাকতো অন্তত আমরা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারতাম। বাড়ির মসজিদ মাদরাসা চলে এলাকাবাসী আর দানশীলদের অনুদানে। মানুষের সাহায্যে গড়ে তোলা হাওলাদার ফাউন্ডেশন সেটিও একই উপায়ে চলে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে বড় মিয়া নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। তবে রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এলাকায় কয়েক একর জমি কিনেছেন, বাড়ি গড়েছেন। ভাইকে ঢাকায় ব্যাগ কারখানা খুলে দিয়েছেন বলেও স্বীকার করনে তিনি।

ফখরুদ্দীন হাওলাদার বলেন, বাহাদুরপুর গ্রামের কয়লা খালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নে সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধাই করিয়েছেন মতিউর রহমান। এছাড়া তার বাড়ি সংলগ্ন প্রতিষ্ঠা করেছেন রহমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, মসজিদ, মাদরাসা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। হাওলাদার ফাউন্ডেশন এসব প্রতিষ্ঠান তদারকি করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌনে দুই একরের কয়েক শতাংশ বেশি জমির ওপর মতিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি। ফসলি জমি রয়েছে ২০ থেকে ৫০ একরের মতো। তবে তার ভাই, চাচাতো ভাইয়েরা বিগত এক দশকে অনেকের জমি কিনেছেন। সেই জমি কার নামে তা জানা যায়নি।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এলাকায় মতিউরের চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক তার মেজো ভাই কাইয়ুম হাওলাদার। ওয়ার্ড বিএনপির রাজনীতি শুরু করলেও বড় ভাই মতিউর রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিন পরেই ঢাকার টঙ্গী এলাকায় ট্রাভেল ব্যাগ তৈরির কারখানা খোলেন তিনি। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে আরো কিছু ব্যবসা রয়েছে। দুই বছর আগে মুলাদী পৌর শহরে কাইয়ুম প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি কেনেন নগদ অর্থে।

মতিউরের ছোট ভাই নূরুল হুদা ঢাকায় থেকে ব্যবসা করলেও এলাকায় তার নামে নতুন কোনো সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি।

মতিউরের বাবা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল হাকিম হাওলাদার শিক্ষকতা পেশা থেকে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসরের পর কাজীরচর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মুলাদী উপজেলা ১৪ দলের সমন্বয়ক ইউসুফ আলীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আব্দুল হাকিম। ওয়ান-ইলেভেনের সময় চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ শেষ হলেও ছেলে মতিউর রহমানের ক্ষমতায় আরও চার বছর বাড়তি দায়িত্ব পালন করেন হাকিম হাওলাদার।

নির্বাচনের স্মৃতি স্মরণ করে স্থানীয় কৃষক রুবেল মিয়া বলেন, ‘ইলেকশনে অনেক টাকা ছিটাইছিল হাকিম হাওলাদার। হের বড় পোলার অঢেল সম্পদ। সেই টাকা ঢাইল্যা দিয়া ভোট কিন্না চেয়ারম্যান হইছে। আমরা তখন ইউসুফ আলীর লোক ছিলাম। এলাকায় চোরের মতো বাস করছি। পুলিশ-প্রশাসন সব কিন্না চেয়ারম্যান হইছিল হাকিম।’

মতিউর রহমান ১১তম বিসিএসে ট্রেড ক্যাডারে সরকারি চাকরি শুরু করেন। তবে ট্রেড ক্যাডার বিলুপ্ত হলে নিজের পছন্দে রাজস্ব ক্যাডারে যোগ দেন। সেখানে যোগ দিয়ে আস্থা অর্জন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের। এরপর আর অর্থবিত্তে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

কাজিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাস বলেন, মতিউর রহমানের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার মেজো ভাই আব্দুল কাইয়ুম ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। মতিউর রহমান এলাকায় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ করেছেন সেটি বাহারদুরপুরের কয়লা খাল দখল করে। খালটি বন্ধ করায় চাষাবাদে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া শুধু তার বাড়ির গুরুত্ব বাড়াতে আশ্রয়কেন্দ্র করেছেন, একটি খালের দুই পাড় বাঁধাই করেছেন। এগুলো অপ্রয়োজনীয়। তার হয়তো উপকারে এসেছে। এলাকার মানুষের তেমন কোনো উপকারে আসেনি। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর