বরগুনার আমতলী উপজেলার হলদিয়াহাট সেতু ভেঙে একটি মাইক্রোবাস নদীতে পড়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়। শনিবার (২২ জুন) দুপুরে বরের বাড়িতে বউভাতের দাওয়াতে যাওয়ার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একসঙ্গে এতো মানুষের মৃত্যুতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ একটি সেতু দীর্ঘদিনেও কেন সংস্কার করা হলো না? তবে দুর্ঘটনার পর এর কারণ উদঘাটনে ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করেছে বরগুনা জেলা প্রশাসন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হালকা যান নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ৮৫ মিটার দৈর্ঘ্যের হলদিয়াহাট সেতুটি নির্মাণের জন্য ২০০৮ সালের ৩১ অক্টোবর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। সেতুটি নির্মাণের ৫ বছরের মধ্যেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছরে সেতুটির আর কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি। ঝুঁকি এড়াতে সেতুর পাশে ঝুঁকিপূর্ণ লেখা একটি সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি যান চলাচল রোধে সেতুর মুখে গাছ পুঁতে দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে সেই গাছ তুলে যান চলাচল অব্যাহত থাকে বলে দাবি আমতলী উপজেলা প্রকৌশল বিভাগের।  

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, সেতুটি নির্মাণের সময়েই অনিয়ম করা হয়েছে। নিম্নমানের মালামাল দিয়ে সেতুটি নির্মাণের ফলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও কোনো প্রকার সংস্কার না করে শুধু ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড ও গাছ পুঁতে দায়সারা কাজ করে কর্তৃপক্ষ। তাদের এ গাফিলতির কারণেই এ প্রাণহানি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।  

সরেজমিনে হলদিয়া ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া সেতুটি ঘুরে দেখা যায়, সেতুটি নির্মাণের মাত্র ১৫ থেকে ১৬ বছর সময় পার হলেও সেতুটি দেখে মনে হয় বহু পুরোনো একটি সেতু। সেতুর কয়েকটি জায়গায় ভেঙে আছে দুই পাশের রেলিং। এ ছাড়া মরিচা ধরে সেতুর পিলারের অবস্থাও বেহাল।

হলদিয়া ইউনিয়নের একজন বাসিন্দা সুভাষ দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেতুটি নির্মাণের সময় অনিয়ম করা হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সেতুতে অনিয়ম না হলে এমন ঘটনা ঘটতো না। আমাদের এ ইউনিয়নে আরও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ সেতু আছে সেগুলো দ্রুত সংস্কার করা হোক।

আমতলীর উপজেলার আরেক বাসিন্দা আব্দুর রহমান সালেহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেতুটি নির্মাণের পর থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ছিল। নিম্নমানের মালামাল দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেতুটি। সে সময় স্থানীয়রা অনিয়মের অভিযোগ তুললেও তা আমলে নেননি কর্তৃপক্ষ। যার ফলে সেতু ভেঙে ৯ জনের প্রাণ গেল। আমতলীর ইতিহাসে এটি একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

চাঞ্চল্যকর এ দুর্ঘটনার পর সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার দোহাই দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এলজিইডির আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখানে যোগদান করেছি বেশিদিন হয়নি। তারপরও যতদূর জানি ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। আমাদের এ এলাকা লবণাক্ত হওয়ায় সেতু নির্মাণে ব্যবহৃত স্টিল স্টাকচারে মরিচা ধরেছে। আমরা আগেই এ সেতুটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছি। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী সেতুর উভয় দিকে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড ও প্রবেশমুখে গাছ পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাহিন্দ্র গাড়ি বা অন্য ভারী যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে রাতের আঁধারের কে বা কারা তা সরিয়ে ফেলেছে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও ইঞ্জিনিয়ারের সাইনবোর্ড দেওয়ার পর তাদের সাইনবোর্ডের গুরুত্ব বোঝা উচিত ছিল। 

নিহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত ৬ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। উপজেলা প্রকৌশল দপ্তর থেকে সেতুর ওখানে সাইনবোর্ডসহ যান চলাচল বন্ধ করতে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে রাতের আঁধারে কেউ সেই ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এখন পর্যন্ত আমরা এটুকু জানতে পরেছি।

উল্লেখ্য, আমতলী উপজেলার চাওড়া ইউনিয়নের উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের মাসুম বিল্লাহর মেয়ে হুমায়রা আক্তারের সঙ্গে গত শুক্রবার আমতলী পৌর এলাকার বাসিন্দা সেলিম মাহমুদের ছেলে সোহাগ মিয়ার বিয়ে হয়। শনিবার দুপুরে বরের বাড়িতে বউভাত অনুষ্ঠান ছিল। কনের পক্ষের লোকজন মাইক্রোবাস ও একটি ইজিবাইকে বউভাতের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। সেদিন বেলা দেড়টার দিকে মাইক্রোবাস ও ইজিবাইকটি দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া-হলদিয়াহাট এলাকায় চাওড়া নদীর ওপর সেতু পার হচ্ছিল। মাঝামাঝি আসতেই সেতুটি ভেঙে গেলে এতে মাইক্রোবাস ও ইজিবাইকটি নদীতে ডুবে যায়।

এ সময় ইজিবাইকে থাকা যাত্রীরা সাঁতরে কিনারে উঠতে পারলেও মাইক্রোবাসের যাত্রীরা নদীতে তলিয়ে যান। তাৎক্ষণিক স্থানীয় লোকজন ওই মাইক্রোবাসে থাকা লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালান। খবর পেয়ে আমতলী উপজেলা সদর থেকে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের দুটি দল দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। পরে মাইক্রোবাসে থাকা কনেপক্ষের ৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়

মো. আব্দুল আলীম/এএএ