কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে তিস্তার পানি রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। তবে রোববার (২৩ জুন) সন্ধ্যা ৬টায় পানি কিছুটা কমে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুই দিন আগ থেকে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে নতুন করে ভাঙছে নদীর তীর ও বসতভিটা। দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিস্তাপাড়ের লোকজন।

এদিকে, এখন পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কাউনিয়া, গংগাচড়া ও পীরগাছা উপজেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন তীব্র হচ্ছে। ভাঙন রোধে নিজ খরচে কেউ কেউ বালুর বস্তা ফেলছেন। পরিবারের সব সদস্যরা মিলে নিজ বাড়ি রক্ষায় নেমে পড়েছেন। যার যা সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে চেষ্টা করছেন তারা। আবার অনেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন বাড়িঘর।

আজ রোববার দুপুরে কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই এলাকায় শতাধিক পরিবারের বসতভিটা নদীর কিনারে দেখা যায়। এসব বসতভিটার লোকজন বাড়িঘর কোথায় সরিয়ে নেবেন, তা নিয়ে বিপাকে আছেন। ভাঙনকবলিতরা অভিযোগ করেন, বর্ষা মৌসুমে ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, সেইসঙ্গে এখনো তাদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সরকারকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন অসহায় ভুক্তভোগীরা।

গদাই এলাকার  নজরুল ভান্ডারি জানান, এর আগে কয়েক দফায় নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন তিনি। এবার ভাঙলে তার আর বসতভিটার কিছুই থাকবে না। বাধ্য হয়ে বাঁধের উপর অথবা অন্য কোথাও স্থান নিতে হবে।

এমন অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে মোজাফফর আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাপ-দাদার ভিটামাটি ছাড়ি অন্যটে যাবার মন চায় না। ওই তকনে প্রত্যেক বছর নদী ভাঙলেও হামরা কষ্ট করি এ্যটে কোনো আছি। কিন্তুক এদোন করি আর কতদিন থাকমো বাহে? ছাওয়ারা (ছেলে-মেয়ে) আর নদীর বগলোত থাকপার চায় না।’

কৃষক আনসার আলীর এক বছরে প্রায় ৭০ শতাংশ আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন মাত্র পাঁচ শতক জমির ওপর বসতভিটা আছে। এখানে-ওখানে কাজ করে সংসার চলে তার। পঞ্চাশোর্ধ বয়সী এই কৃষক বলেন, ‘এবার বসতভিটা নদীত চলি গেইলে আর কোনো জমি থাকপার নয়। নদী হামার সোগ শ্যাষ করি দেলে।’

নদীভাঙন কবলিত গদাই এলাকায় এক মাস আগে ১৮০ মিটার স্থানে নদীর ভাঙন রোধে দুই হাজার বালুর বস্তা ফেলা হয়। স্রোতের তোড়ে বেশির ভাগ বস্তা ভেসে গেছে। সেখানকার আবদুল মালেকের টিনের বাড়ি ও চারটি ঘর ভাঙনের মুখে থাকায় অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন তিনি। এই প্রতিবেদককে আব্দুল মালেক বলেন, ‘ঘর ভাঙিয়া যে অন্যটে সরে নিয়া যামো, সেই জায়গাও নাই। কারও জমি ভাড়া নেওয়া লাগবে। হাতোত কোনো টাকাও নাই। সেই চিন্তায় ঘুম হয় না।’

বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গদাই গ্রামে প্রায় ৪০০ পরিবারের বাস। এর মধ্যে শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর ভাঙনের মুখে পড়েছে।

এদিকে গদাই ছাড়াও কাউনিয়ায় তিস্তা তীরবর্তী চরের ঢুষমারা, তালুক শাহবাজ, গদাই, পূর্ব নিজপাড়ার অংশ, গোপীডাঙ্গা, আরাজি হরিশ্বর, চর প্রাণনাথ, শনশনিয়া, চর হয়বতখাঁ, আজমখাঁর চর গ্রামের নিম্নাঞ্চলে পানি কমতে করেছে। এসব এলাকায় আমন ধানের বীজতলা, উঠতি বাদাম খেত পানিতে ডুবে গেছে, সেই সঙ্গে প্রায় অর্ধ শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। এর মধ্যে আরও পানি বৃদ্ধি পেলে নতুন নতুন এলাকায় বন্যা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব চরাঞ্চলের কৃষকেরা।

বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী জানান, তিস্তা আর আগের জায়গায় নেই। গত বছরের উজানের ঢলের সঙ্গে পলিমাটি এসে প্রায় এক ফিট উঁচু হয়ে গেছে তিস্তার তলদেশ। যার ফলে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলেই এই পানি মুহূর্ত দক্ষিণ তীরের নিম্ন অঞ্চলে প্রবেশ করে আর শুরু হয় ভাঙন।

তিনি আরও বলেন, গত তিন দিন থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় এই পানি এখন কমতে শুরু করেছে। পানি কমলেও তিস্তা দক্ষিণ তীর কাউনিয়ার গদাই এলাকার বেশ কিছু জায়গায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এই এলাকার যোগাযোগের একটু ছোট রাস্তা সেটিও ভেঙে গেছে। আমরা স্থানীয়ভাবে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছি, পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি।

পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব বোল্ডারের মাথা গ্রামের কৃষক ফয়জুর রহমান জানান, পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক দিনে নদী ভাঙতে ভাঙতে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। অনেকেই ভাঙন আতঙ্কে ঘরবাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন। এই এলাকার কৃষকরা চর থেকে বাদাম তুলতে না পেরে এবারের আকস্মিক বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে কাউনিয়ায় তিস্তা সেতু এলাকায় শুক্রবার (২১ জুন) নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আজ রোববার সন্ধ্যা ৬টায় রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, তিস্তা সেতু এলাকায় পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পানি আরও কমে যাবে। তবে ভারী বৃষ্টিপাত ও উজানের পাহাড়ি ঢল না এলে তিস্তার পানি দু-একদিনের মধ্যে অনেক কমবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, পানি কমলেও ভাঙনের আশঙ্কা আছে। ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। এক মাস আগে এক হাজার বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। ভাঙন রোধে চেষ্টা চলানো হচ্ছে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ