সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়ন ও সুরক্ষার তাগিদে প্রেসক্লাব নামক সাংবাদিক সংগঠনের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে তা হয়ে উঠেছে দখলদারিত্ব আর ব্যবসা চালানোর মাধ্যম। প্রেসক্লাবের বাইরেও রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাংবাদিক সমিতি, সাংবাদিক ক্লাব, অনলাইন ক্লাবসহ নানা নামে খোলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠান৷ ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায়ও এমন চিত্র দেখা গেছে। আয়তনে ছোট উপজেলা হলেও সবমিলিয়ে ৬টি প্রেসক্লাব ছাড়াও নামে-বেনামে আরও কিছু সংগঠন সাংবাদিক পরিচয়ে 'চাঁদাবাজি' করে আসছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় ২ কোটি বিভিন্ন সরকারি জায়গা দখল করে একাধিক অফিস গড়ে তোলা হয়েছে, যেগুলো থেকে রাত-বিরাত পর্যন্ত ব্যবসা চালানোর অভিযোগ উঠছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নান্দাইল উপজেলায় সবমিলিয়ে ৬টি প্রেসক্লাব আছে। এর বাইরেও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থাসহ আরও কিছু সাংবাদিক সংগঠনের কার্যক্রমও আছে। এগুলোর মধ্যে চৌরাস্তা বাজারে অবস্থিত প্রেসক্লাবটি (নান্দাইল প্রেসক্লাব) সবচেয়ে পুরাতন এবং প্রধান প্রেসক্লাব হিসেবে ধরা হয়, যেটি তাদের নিজস্ব জায়গায় কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এদিকে নান্দাইল নতুন বাজারে অবস্থিত 'ডিজিটাল প্রেসক্লাব' নামক সংগঠনটিও ব্যক্তি-মালিকানা জায়গায় ভাড়া করা অফিসে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়াও 'মডেল প্রেসক্লাব', 'নান্দাইল উপজেলা প্রেসক্লাব', 'প্রেসক্লাব নান্দাইল' নামক তিনটি প্রেসক্লাব সরকারি জায়গা দখল করে অফিস স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি নান্দাইল জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার অফিস সরকারি দখলকৃত জায়গায় ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়াও সম্প্রতি নান্দাইল সদর প্রেসক্লাব নামক আরেকটি সাংবাদিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।

সাংবাদিকদের মধ্যে বিভেদ, পৃথক অফিস এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, নামে-বেনামে প্রেসক্লাব খুলে এখন অনেকেই প্রতারণায় নেমেছেন। নাম-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকেরা এগুলো করছেন। ছোট উপজেলার অলিতে-গলিতেই এখন প্রেসক্লাব। এদের সঙ্গে মূল ধারার সাংবাদিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। বেশ কয়েকটা প্রেসক্লাব গত কয়েকদিনে হয়ে গেছে, যেখানকার সদস্যদের অধিকাংশই অপরিচিত মুখ। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেকেরই এসব ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত।

এদিকে গত বুধবার (১৯ জুন) নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের মূল ফটকে হলুদ অপেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও সরকারি জমি দখলের অভিযোগে আমরণ অনশন শুরু করেন নান্দাইল সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এফএম রিগ্যান আহমেদ (ফাহাদ)। আজ দ্বিতীয় দিনের মতো অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এবিষয়ে যোগাযোগ করা হলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

অনশন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এফএম রিগ্যান আহমেদ বলেন, নান্দাইল থানার পাশেই সরকারি জায়গা দখল করে প্রেসক্লাবের নামে একেকটা দালাল অফিস করা হয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। থানায় মানুষ সেবা নেওয়ার জন্য গেলেই পুলিশের আগেই তারা দালাল সাংবাদিকদের খপ্পরে পড়ে। সাধারণত কোন প্রেসক্লাবে রাত ১০টার পর কোন কাজ থাকে না। কিন্তু নান্দাইলের অলিতে-গলিতে গড়ে উঠা এসব প্রেসক্লাবের তৎপরতা শুরুই হয় রাত ১০টা পর, চলে রাত ২/৩টা পর্যন্ত। তারা মূলত সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি দফতরে গিয়ে চাঁদাবাজি করে। এতে করে পেশাদার সাংবাদিকদের মর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

তিনি বলেন, নান্দাইলের মতো উপজেলায় ছয়টা প্রেসক্লাব। এছাড়াও সাংবাদিক সংস্থাসহ আরও আনাচে কানাচে বেশ কিছু সাংবাদিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে তিনটি সাংবাদিক সংগঠনের অফিস করা হয়েছে দখলকৃত জায়গায়। এরমধ্যে দুটি প্রেসক্লাব এবং একটি সাংবাদিক সংস্থা আছে। আমার ধারণা এই তিনটি ক্লাব মিলিয়ে সরকারি প্রায় ২ কোটি টাকার জায়গা দখল করা হয়েছে।

রিগ্যান আহমেদ আরও বলেন, অবৈধ জায়গায় অফিস নিয়ে সাংবাদিকতার কার্যক্রম করলে স্বাভাবিকভাবেই এখানে নীতি-নৈতিকতা থাকে না। কারণ সাধারণ মানুষকে আপনি কী দিবেন, নিজেই তো অবৈধ কার্যক্রম করছেন। সমাজের আয়না আপনারা কিভাবে হবেন? আমরা ভাবি সৎ এবং পেশাদার সাংবাদিক সমাজের আয়না। কিন্তু প্রায় সময় দেখি ২০০ টাকার বিনিময়েও সাংবাদিকরা বিক্রি হয়ে যায়। নান্দাইল থেকে এসব অপ-সাংবাদিকদের বিতাড়িত করার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে মূলধারার সাংবাদিকদের আমি পাশে থাকার অনুরোধ করছি।

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার অরুণ কৃষ্ণ পাল বলেন, অবৈধ দখলকৃত জমি উদ্ধারে আমরা আরও আগেই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছি। নান্দাইলের মূল সড়কের দুইপাশ মিলেয়ে দেড়শ ফিট জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছিলো। এখন হয়তো সর্বসাকুল্যে ৫০ ফিটের মতো আছে, বাকি ১০০ ফিটই দুই পাশের মানুষ দখল করে আছে। ইতিমধ্যে কয়েকটা পিক পয়েন্টে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি এবং সবমিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকার সরকারি জমি উদ্ধার করেছি। অভিযানটা আমাদের একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়ে যাবো।

তিনি বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি প্রেসক্লাবের নাম করে সরকারি জায়গা দখল করে অফিস করা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই সড়ক বিভাগের সাথে কথা বলেছি। তবে কার্যক্রম শুরু করতে কিছুটা সময় লাগবে। আশা করছি নান্দাইলবাসী এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে নিয়েই আমরা আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এর আগে গত ১১ জুন নান্দাইলে হলুদ- অপেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষদের হয়রানি ও সরকারি দপ্তরে চাঁদাবাজি, থানায় দালালি এবং সরকারি জায়গা জবরদখল করে কথিত প্রেসক্লাব করার প্রতিবাদে পৌর সদরে বিক্ষোভ মিছিল করে স্থানীয় এলাকাবাসী। এরপর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি স্মারকলিপি দেন তারা। এতে তারা তিন দফা দাবি উপস্থাপনের মাধ্যমে সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

স্থানীয়দের দাবিগুলো হলো-

১. সরকারি জায়গায় জবরদখলকৃত কথিত প্রেসক্লাবগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।

২. নান্দাইল থানায় সাংবাদিকতার নামে দালালি বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

৩. নান্দাইল উপজেলার সকল সরকারি দপ্তরের সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি ও দালালি বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, অন্যের জমি নিজের দখলে রাখা, ভুয়া বা মিথ্যা দলিল তৈরি এবং নিজ মালিকানার বাইরে অন্য কোনো জমির অংশবিশেষ উল্লেখ করে দলিল হস্তান্তরে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন হচ্ছে। গত বছরের শেষের দিকে এ সংক্রান্ত ‌'ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল–২০২৩' সংসদের বৈঠকে উত্থাপন করেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। পরে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

বিলে বলা হয়, ভূমি হস্তান্তর, জরিপ ও রেকর্ড হালনাগাদে অন্যের জমি নিজের নামে প্রচার, তথ্য গোপন করে কোনো ভূমির সম্পূর্ণ বা অংশ বিশেষ কারও কাছে হস্তান্তর, ব্যক্তির পরিচয় গোপন করে জমি হস্তান্তর ও মিথ্যা বিবরণ সংবলিত কোনো দলিলে সই করলে তার সাজা হবে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড।
    
এতে আরও বলা হয়, কোনো দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া প্রতারণামূলকভাবে দলিলের কোনো অংশ কাটা বা পরিবর্তন করলে তার সাজাও হবে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কোনো মিথ্যা দলিল প্রস্তুত করার সাজাও একই। 

এ ছাড়া প্রতারণামূলকভাবে কোনো ব্যক্তিকে কোনো দলিলে সই বা পরিবর্তনে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও একই সাজা ভোগ করতে হবে।

টিআই/এমএসএ