প্রতি বছরের মতো এবারো পশু কোরবানির পর পাড়া-মহল্লা থেকে গরু ও খাসির চামড়া কেনেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। গতবারের চেয়ে এবার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৭ টাকা বাড়ানো হলেও কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। 

ঢাকায় প্রতি পিস গরুর চামড়ার দাম ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও রংপুরে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। সরকার নির্ধারিত লবণযুক্ত চামড়ার দামের অর্ধেক দামেও চামড়া বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। 

গত কয়েক বছরের মতো এবারও রংপুরে কোরবানির পশুর চামড়া ‘সস্তা দামে’ বেচা-কেনা হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য দাম পাননি কেউ। হাতেগোনা কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সামান্য লাভের মুখ দেখলেও কোরবানির চামড়ায় মোটা অংকটাই গিলতে গা করে আছেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা। 

প্রতিবছর এ রকম সিন্ডিকেটের ফাঁদে রংপুরে একদিকে কমছে কোরবানির পশুর চামড়ার আমদানি। অন্যদিকে ন্যায্য দাম না পেয়ে চামড়া মাটিচাপা দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

এদিকে গত ৩ জুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী  আহসানুল ইসলাম চামড়ার দাম  নির্ধারণ সভায় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ঢাকায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া যদি ২০ বর্গফুট হয়, তখন ওই গরুর চামড়ার দাম হবে ১ হাজার ২০০ টাকা। ঢাকার বাইরে হবে এক হাজার টাকা।’

প্রতিবছর সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করলেও মানুষ সে দাম পান না, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এবার ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নজরদারি করবে। এখানে সরকারের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। তাই কোরবানির পশুর চামড়া কম দামে বিক্রি হবে না।’

সরকারের বেধে দেওয়া চামড়া দাম নির্ধারণ শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকায় ‘সিন্ডিকেট’ বলয় এবারও ভাঙতে পারেননি সাধারণ ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা। ঈদের দিন রংপুর নগরীর চামড়া কেনাবেচার সবচেয়ে বৃহৎ এলাকা হাজীপাড়া চামড়াপট্টিতে ছিল না ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নজরদারি। 

এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরো চামড়ার বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নেন আড়তদারসহ বড় বড় ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেটের ফাঁদ পাতানো ব্যবসায়ীরা ‘গরীব -দুঃখীর হক সংকুচিত’ করে প্রতিবছর লুটে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।

সচেতন মহল বলেছে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামাতে না পারলে গরীব-দুঃখীরা তাদের হক বঞ্চিত হবেন। তেমনি কোরবানির পশুর চামড়া মাটিচাপা দেওয়া রীতিতে পরিণত হবে। সিন্ডিকেট বন্ধ করে চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও ঋণ সুবিধার আওতায় আনতে হবে।

এদিকে সাধারণ মানুষ এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চামড়ার জন্য প্রসিদ্ধ রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর টার্মিনাল রোডের চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ীরাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে এবারও সস্তায় চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গরুর চামড়ায় দাম মিললেও ছাগলের চামড়া ফ্রি-তে দিতে হয়েছে। চামড়ার দাম কম দিতে নানা অজুহাতের ফাঁদগল্প শুনতে হয়েছে তাদের।

নগরীর বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়। মৌসুমি চামড়া বিক্রেতারা জানিয়েছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া কিনে আনার পর আড়তদারদের কাছে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যায়নি। এতে করে হতাশ তারা।

ইকবাল সুমন নামের একজন তার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করেছেন মাত্র ৪০০ টাকায়। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, চামড়া বেচতে এসে দাম শুনে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এক লক্ষ টাকা দিয়ে গরু কিনে, সেই গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয় পানির দামে। সরকারের বেধে দেয়া দামের কোন প্রভাব পড়েছি। বরং বড় বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের ফাঁদের প্রভাব পুরো চামড়াপট্টি জুড়ে। উপায় না থাকায় কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এতে করে আমার ক্ষতি না হলেও সাধারণ গরীব-মিসকিনের তো ঠিকই ক্ষতি হচ্ছে। কারণ কোরবানির পশুর চামড়ার টাকায় তো তাদের হক রয়েছে।

তবে চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের দাবি, সিন্ডিকেট রংপুরের মতো মফস্বলে পর্যায়ে হয়নি, এটি ঢাকায় হয়ে থাকে। মূলত পুঁজি সংকটসহ লবণের দাম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তারা চামড়া কিনতে পারেননি। বড় ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে লবণের দাম বেশি। এর ওপর শ্রমিকের মজুরির কারণে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ঈদুল আজহার প্রথম দিন (১৭ জুন) দুপুর ১২টার পর থেকেই রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর টার্মিনাল রোডের হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকায় চামড়া কেনা-বেচা শুরু হয়। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কোরবানির পশুর চামড়া বেচতে এই এলাকায় আসেন। 

এবার হাতেগোনা পাঁচ-ছয়জন বড় ব্যবসায়ী ও আড়তদার ছাড়া বেশিরভাগ মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা কম মূল্যে চামড়া কিনেছেন। গরুর চামড়ার নামমাত্র মূল্য পেলেও অনেকেই ছাগল-ভেড়ার চামড়া ফ্রিতে দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমদানি কম হওয়াতে প্রথমদিনে রাত ১২টা পর্যন্ত চামড়া কেনাবেচা করতে দেখা যায়।

রংপুর নগরীর হাজিরহাট থেকে ১৫০ পিস চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান জানান, প্রতিবর্গফুট মাঝারি গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে ৮০০ এবং বড় গরুর চামড়া এক হাজার থেকে বারোশ দাম হওয়ার কথা। তিনি ওই হিসাবে গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছেন। গাড়ি ভাড়া আনুষঙ্গিক খরচসহ সাড়ে ৬০০ টাকা পড়েছে প্রতি পিস চামড়া কিনতে। কিন্তু আড়তদাররা ৫০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনতে রাজি না হওয়ায়তাকে মোটা অংকের লোকসান মেনে নিতে হয়েছে। 

একই কথা জানিয়েছেন নগরীর সিও বাজার এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী। তিনিও গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনে এনে সস্তা দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

ঈদের দিন সকাল থেকে পাড়া মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ৩০টি গরুর ও ৫০টি খাসির চামড়া কেনেন সোহেল রানা। নগরীর স্টেশন রোড এলাকায় মৌসুমী এই ব্যবসায়ী জানান, এবার তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরুর চামড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা মূল্যে কিনেছেন। আর ছাগলের চামড়া নেন ৫-২০ টাকা করে। সন্ধ্যায় সেগুলো স্থানীয় চামড়াপট্টিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছেন। 

তবে গরুর চামড়া দুই ক্যাটাগরিতে দুই রকম দামে ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে তাকে লোকসান গুনতে হয় চার হাজার টাকা। আর ছাগলের চামড়ার পুরো অর্থটাই তার গচ্ছা গেছে। সিন্ডিকেটের কারণে তিনি ন্যায্য দাম পাননি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

অন্যদিকে, রংপুর নগরীর দর্শনা এলাকার সৌখিন চামড়া ব্যবসায়ী বাবুল ইসলাম, কামারপাড়ার আসাদুল ও আদর্শপাড়ার এরশাদ মিয়া জানিয়েছেন, আড়তদারদের ফুট হিসেবে চামড়া কেনার কথা কিন্তু তারা তা না করে মাঝারি চামড়া ২৫০ থেকে ৪০০, বড় চামড়া ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা দাম নির্ধারণ করেন। 

তারা সরকারের দেওয়া নির্দেশনা না মেনে তাদের ইচ্ছেমতো চামড়া কিনেছেন। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় আড়তদারদের এই সিন্ডিকেট নিয়ে কাউকে অভিযোগ করার মতো সুযোগও ছিল না।

একই রকম অভিযোগ সখের বশে চামড়া কেনা মামুন ইসলাম। এই মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, মিডিয়ার লোকেরা যখন ক্যামেরা ধরছে তখন বড় বড় ব্যবসায়ী মিথ্যা কথা বলছে। আমাদের সামনে টিভিতে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় চামড়া কিনছে বলে প্রচার করছে। অথচ মিডিয়ার লোক চলে যাবার পর নানা ছুতোয় আড়তদাররা সস্তা দামে চামড়া কিনেছেন। আমি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার একটা কোরবানির গরুর চামড়া ৭০০ টাকায় বিক্রি করেছি। ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। সেগুলো রাস্তায় ফড়িয়াদের ফ্রিতে দিয়ে এসেছি।

সাধারণ মানুষ আর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগের শেষ নেই। একেকজনের একেক রকম অভিযোগ হলেও সবাই শঙ্কিত চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ রকম সিন্ডিকেট আর অশুভ ফাঁদে এই শিল্প দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে। যার কারণে প্রতিবছর ‘গরীবের হক’ ধরাশয়ী হচ্ছে বড় ব্যবসায়ীদের বড় বড় ফাঁদে। যদিও এসব অভিযোগ মানতে আড়তদারসহ বড় ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এবার সাধারণ লোকজন চামড়ার ভালো দাম পেয়েছেন। দু-এক জায়গায় কম দামে বিকিকিনি হলে সেটা চামড়ার আকার ও ধরণের ওপর নির্ভর করে হয়েছে।

সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশের শর্তে চামড়াপট্টি এলাকার প্রবীণ এক ব্যবসায়ী জানান, এবার গুটিকয়েক চামড়া কিনেছেন। তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে সিন্ডিকেট না হলেও অন্তরের চাওয়া-পাওয়ায় মিল ছিল। এ কারণে চামড়ার দাম খুব বেশি উঠেনি। এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবং খারাপ আচরণের কারণে বাইরের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং ট্যানারির প্রতিনিধিরা এই এলাকায় আসতে পারেন না। এটার প্রভাব পড়েছে চামড়ার দামে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মাহাবুবার রহমান বলছেন, চামড়া শিল্পে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা নিজেরাও সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে থাকেন। চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের দেন। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন ট্যানারি মালিকদের কাছে এখন তাদের অনেকেই জিম্মি। বিগত কয়েক বছর ধরে ন্যায্য দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর ১৫-২০ জন ফড়িয়া ও অর্ধশত মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং হাতেগোনা ৬-১০ জন ব্যবসায়ী চামড়া কিনলেও এ বছর বেশির ভাগকেই চামড়া কেনা-বেচায় দেখা যায়নি। সবমিলিয়ে চার-পাঁচজন ছাড়া চামড়া কেনার মতো বড় কোনো ব্যবসায়ী ও আড়তদার ছিল না এ এলাকায়। অথচ এক সময় চামড়াপট্টি এলাকায় শতাধিকের বেশি চামড়ার গুদাম ছিল। 

রংপুরের বাইরের আড়তদারদের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। চামড়া ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল হাজীপাড়া চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি এবং জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি। এসব এখন ইতিহাস। যে কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন, তারাও এখন ঈদকে ঘিরেই কোমর বাঁধেন। পেশা বদলের কারণে বছরের বাকি সময়টা থাকে না চামড়া কেনার তোড়জোড়।

এই এলাকায় দিন দিন গুদাম বন্ধের সঙ্গে চামড়া বিমুখ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে এখানে। আগের মতো চামড়া ব্যবসার রমরমা দিন না থাকায় সমবায় সমিতি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে অনেকেই গড়ে তুলেছেন অটোবাইক ও রিকশার দোকান। কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন অটোরিকশা তৈরির কারখানা। এ কারণে চামড়াপট্টিতে এখন চামড়া নিয়ে তেমন মাতামাতি নেই। তবে ঈদের সময়ে চামড়া কেনাবেচা হলেও সেখানে 'সিন্ডিকেটের অশুভ ছায়া' কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

চমড়া ব্যবসায়ী শামছুল হক, মশিয়ার রহমান ও মোখলেছুর রহমান জানান, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন যারা বাপ-দাদার এই ব্যবসা ধরে আছেন, তারা হাতে গোনা কয়েকজন।

এই ব্যবসায়ীদের দাবি, একেকটি ভালো মানের গরুর চামড়া তারা ৭০০-৯০০ টাকায় কিনেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক হাজার টাকারও বেশি কেনা পড়েছে। এসব চামড়া লবণজাত করতে হলে শ্রমিকসহ আলাদা খরচ রয়েছে। সবমিলিয়ে সরকারের বেধে দেয়া দামের কাছাকাছি মূল্যেই তারা চামড়া কিনেছেন। শুধু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা লোকসান গুনে থাকে এমনটা নয়, কখনো বড় বড় ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা কোটি কোটি টাকার লোকসানে পড়েন বলেও জানান তারা।

রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফজাল হোসেন বলেন, সিন্ডিকেট করে কি লাভ? এমনিতেই চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণের বিকল্প কোনো উপায় নেই। এখন আমদানিও কম। লবণের দাম তো বেড়েই চলেছে। এত কিছুর মাঝেও ট্যানারি মালিকেরা সরকারের কাছ থেকে ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে ঋণ সুবিধার বাইরে রয়েছি। আমাদের ঋণ দেওয়া হয় না। অথচ বড় বড় ট্যানারি মালিকেরা চামড়া ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে তা অন্যখাতে বিনিয়োগ করছে।

তিনি আরও বলেন, চামড়া কিনে কোথায় বিক্রি করা হবে, এ নিয়েই চিন্তিত বড় ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের প্রায় দুই শতাধিক ট্যানারির মধ্যে হাতেগনা কয়েকটি ট্যানারি চালু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের বোঝা ভারী করতে চাইছেন না। আর যারা কিনছেন তারা তো লোকসান এড়ানোর চেষ্টা করবেন এটাই স্বাভাবিক।

ভালো দাম না পাওয়া প্রসঙ্গে প্রবীণ চামড়া ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী বলেন, চামড়ার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বর্তমানে সাধারণ লোকজন থেকে শুরু করে চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউই ভালো দাম পাচ্ছেন না। এমনিতে দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে অথবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। তাই চামড়া শিল্পে ব্যাংক ঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন জরুরি।

এদিকে, রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এনামুল হক জানিয়েছেন, এবার রংপুর মহানগরীসহ পুরো জেলাতে দুই লাখের বেশি গরু কোরবানি হয়েছে। খাসি হয়েছে প্রায় লাখের কাছাকাছি। কোরবানির পশুর এসব চামড়া স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সংগ্রহ করে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বা আড়তে পৌঁছে দেন। আড়তগুলো এসব চামড়া লবণজাত করে সংরক্ষণের ১৫ দিন থেকে এক মাসের মধ্যে ট্যানারি মালিকদের কাছে বা বিভিন্ন চামড়ার হাটে বিক্রি করে থাকেন।

তবে বিসিক রংপুর জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. এহেছানুল হক জানান, কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে বিসিক বিনামূল্যে লবণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যেসব বেসরকারি মাদ্রাসা ও এতিমখানা কুরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ করবে, সেসব মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিনামূল্যে লবণ বিতরণ করা হয়েছে। বিসিক রংপুর জেলা কার্যালয় ১৫ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ কেজি লবণ বিতরণ করেছে। এ ছাড়া বিসিক কার্যালয় কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বার্তাবহুল লিফলেট বিতরণ করছে।

তিনি আরও বলেন, রংপুরে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে ব্যবহৃত লবণের কোনো ঘাটতি নেই। রংপুর জেলায় কুরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন ২ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন লবণ। রংপুর জেলায় মজুতকৃত লবণের পরিমাণ ২ হাজার ২৯৯ মেট্রিক টন।

এমএসএ