গাড়ি চলবে মস্তিষ্কের স্নায়ুর সাহায্যে। শরীরের সাথে লাগানো একটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস গাড়িকে কন্ট্রোল করবে। আর এ গাড়ি চালাতে পারবে যেকোনো বয়সের শারীরিক প্রতিবন্ধী বা হাত-পাবিহীন মানুষ।  

প্রযুক্তিটি অবিশ্বাস্য শোনালেও এমনি এক ‘এটু আই স্মার্ট কার’ নামক গাড়ি উদ্ভাবন করেছেন ২ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার শারীরিক প্রতিবন্ধী স্কুলছাত্র ওয়াকিমুল ইসলাম রিফাত। তিনি যশোরের চৌগাছা শহরের ব্রাকপাড়া এলাকার আবু খায়েঁরের ছেলে। রিফাত চৌগাছা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন।

ক্ষুদে উদ্ভাবক রিফাত বলেন, বছর পাঁচেক আগে নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে অসুবিধা হলে নিজের মেধা শক্তি কাজে লাগিয়ে এমন একটি গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেন, যে গাড়িটি মানুষের মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফলে শুধু রিফাত নিজেই নয়, রিফাতের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী যেকোনো মানুষ গাড়িটি চালাতে পারবে। গাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঁচ বছর ধরে স্কুলের টিফিনের টাকা জমিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করে এটু আই স্মার্ট গাড়ির প্রজেক্ট। গাড়িটি তৈরি করতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ বছর। টিফিনের টাকার পাশাপাশি ঈদের সেলামি এবং তার বাবাও রিফাতকে গাড়িটি তৈরি করতে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। রিফাতের বাবা আবু খায়েঁর শুধুমাত্র অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেননি। তিনি নিজের পেশাগত কাজের ফাঁকে ছেলে উদ্ভাবনে শ্রম দিয়েও সহযোগিতা করেছেন।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্ষুদে উদ্ভাবক ওয়াকিমুল ইসলাম রিফাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি যখন স্কুলে যেতাম, বাবা আমাকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেত। আমি একা একা যেতে পারতাম না। পাঁচ বছর আগে আমি পরিকল্পনা করি এমন একটি গাড়ি আবিষ্কার করব, যেটি চালিয়ে আমি নিজে নিজেই স্কুলে যেতে পারব। এরপর যেহেতু আমার দুই হাত আছে, সেহেতু আমি প্রথমে দুই হাতলের একটি গাড়ি তৈরি করি। এরপর ভাবলাম যাদের হাত নেই, পা নেই, তারা কি করবে? তখন চিন্তা করলমা এই গাড়িটিকে আরও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ করতে হবে যাতে করে যেকোনো শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ তার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্য গাড়ি চালাতে পারে।

রিফাত আরও বলেন, আমি পরীক্ষামূলকভাবে এই এটু আই স্মার্ট কার গাড়িটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। তবে এটার এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। অর্থের অভাবে কাজ সম্পন্ন করতে পারছি না। এ পর্যন্ত গাড়িটি তৈরি করতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি পুরোপুরি রুপ দিতে আরও ৮০ থেকে ১ লাখ টাকা প্রয়োজন।

রিফাতের বাবা আবু খায়েঁর একজন ক্ষুদ্র কাচামাঁল ব্যবসায়ী। মধ্যবিত্ত পরিবারের খরচ সামলিয়ে ছেলে উদ্ভাবনে অর্থ ও শ্রম দুটো দিয়েই সহযোগিতা করেছেন। আবু খায়েঁর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওকে (রিফাতকে) আমি কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতাম। ও তখন একটি গাড়ি উদ্ভাবন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ও টিফিনের টাকা জমিয়ে গাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। এরপর ওর মেধাশক্তি আর আগ্রহ দেখে আমিও ওকে অর্থ ও শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করেছি। আমি ভাবলাম ও যেহেতু প্রতিবন্ধী, ও যদি নিজের জন্য কিছু তৈরি করতে পারে তাহলে ওরই উপকার। কিন্তু এখন দেখছি ও এমন একটা গাড়িটি তৈরি করেছে যেটি শুধু ও না, হাত-পাবিহীন প্রতিবন্ধীরাও চালাতে পারবে।

রিফাতের বোন লাইবা বলেন, আমার ভাইয়ের প্রতিভা এবং মেধা দেখে আমরাই অবাক হই। ওকে আরও প্রশিক্ষণ বা সরকারি সহযোগিতা করলে ও আরও ভালো কিছু করতে পারবে। ও যে গাড়ি উদ্ভাবন করেছে এটা যে কারো পক্ষে সহজে উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়।

রিফাতের প্রতিবেশী গোলাম মোস্তফা বলেন, আবু খায়েঁর আমাদের প্রতিবেশী। তার ছেলে রিফাত তিলে তিলে যে গাড়ি আবিষ্কার করেছে এটা দেখে আমরা সবাই অবাক হয়েছি। ও প্রতিবন্ধী হয়েও অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালো। আমরা চাই ও অনেক বড় হোক, ওর প্রতিবন্ধকতা জয় করে দেশের জন্য কাজ করুক।

যশোর জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বিজ্ঞান মেলায় আমরা শারীরিক প্রতিবন্ধী দশম শ্রেণির ছাত্র রিফাতের স্মার্ট গাড়ির উদ্ভাবনটি দেখেছি। এটি সত্যিই আশ্চর্যজনক। আমরা রিফাতকে আরও ওপরের দিকে নিয়ে যেতে চাই। তার সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে তাকে উপরের দিকে নিয়ে যেতে যা যা পদক্ষেপ দরকার সেগুলো আমরা নেব।

এ্যান্টনি দাস অপু/আরকে