দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করেন বরগুনার জেলে আব্দুল গনী। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মাছ বিক্রির টাকায় চলে তার সংসার। সমুদ্রে চলমান ৬৫ দিনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞায় বেকার হয়ে পড়া আব্দুল গনীর এ বছর মাংস কেনার সামর্থ্য নেই। 

দুঃখ প্রকাশ করে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এ বছর কোরবানির দিন ছেলে-মেয়ে থুইয়া (রেখে) পলাইয়া থাহা লাগবে। মাছ-মাংস তো কিছু দিবার পারব না। সরকারিভাবে চাল পাইছি তা দিয়ে তো পরিবারই চলে না।’

একই অবস্থা জেলার বিভিন্ন এলাকার সমুদ্রগামী জেলে পরিবারের। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় গত ১৯ মে মধ্যরাত থেকে সাগরে মাছ ধরায় চলছে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা, যা শেষ হবে আগামী ২৩ জুলাই। দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান এ নিষেধাজ্ঞায় বেকার হয়ে পড়েছেন উপকূলের কয়েক হাজার সমুদ্রগামী জেলে। একদিকে ঋণের বোঝা, অপরদিকে কোরবানির ঈদ, প্রিয়জনদের এক টুকরো মাংস কিনে খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই এসব সমুদ্রগামী অনেক জেলেদের। আবার জেলে তালিকায় নাম না থাকায় সরকারি বরাদ্দের চালও পাননি অনেক জেলেরা। ফলে পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করা এসব জেলেদের পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। 

বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী নামক এলাকার একটি আবাসনে বসবাস করেন প্রায় ১৫ থেকে ২০টি সমুদ্রগামী জেলে পরিবার। মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে সরকারের বরাদ্দকৃত ৮৬ কেজি চাল ছাড়া আর কোনো সহযোগিতা পাননি তারা। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের তুলনায় বরাদ্দকৃত এ সহযোগিতা অতি সামান্য বলেও অভিযোগ রয়েছে এখানকার জেলে বাসিন্দাদের। এ অবস্থায় এখন ঈদের দিন পরিবারের মুখে এক টুকরো মাংস তুলে দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের।

সরেজমিনে পোটকাখালী এলাকার আবাসনে বসবাস করা সমুদ্রগামী বিভিন্ন জেলেদের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, বেকার হয়ে পরিবারের সঙ্গে ঘরেই সময় পার করছেন অনেক জেলেরা। আবার কেউ কেউ বিনা পারিশ্রমিকে নিজেদের ট্রলারের জাল মেরামতের কাজ করতে গিয়েছেন ট্রলার ঘাটে।

এসব জেলেদের মধ্যে চলমান ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় বেকার হয়ে পড়া জেলে আব্দুল গনী স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বাড়িতেই সময় পার করছেন। কোরবানির ঈদ কীভাবে কাটবে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, তারা আবাসনের একই জায়গায় প্রায় পাঁচজন জেলে পরিবার বসবাস করে। সবাই সাগরে মাছ শিকারের কাজ করে। চলমান নিষেধাজ্ঞায় তাদের আর্থিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ। তার পরিবারে ৫ জন সদস্য। তার মা স্ট্রোকের রোগী, তাকে প্রতি মাসে প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকার ওষুধ খাওয়াতে হয়। এই অবস্থায় সরকারের দেওয়া চালে তাদের কিছুই হয় না। তারা আলু আর ডাল ভাত ছাড়া এখন কিছুই খেতে পারে না। একদিন পরেই কোরবানির ঈদ, সরকার যদি তাদের দিকে তাকিয়ে একটু আর্থিক সহযোগিতা করতো তাহলে এক কেজি গোস্ত কিনে ছেলে-মেয়ে ও মায়ের মুখে এক টুকরো গোস্ত তুলে দিতে পারত। আর না হলে কোরবানির দিন ছেলে-মেয়ে রেখে তাকে পালিয়ে থাকতে হবে।

জেলে আব্দুল গনীর স্ত্রী হনুফা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে সাগরে মাছ শিকারে যেতে পারেননি। এ কারণে বাচ্চাদের নিয়ে আমরা সমস্যার মধ্যেই দিন পার করছি। আলু, ডাল দিয়ে সরকারি যে চাল পেয়েছি তা দিয়ে ভাত খেয়ে আছি। সরকারিভাবে যদি দুই এক হাজার টাকার ব্যবস্থা করতো তাহলে কোরবানির দিন অন্তত এক কেজি গোস্ত কিনে ছেলে-মেয়েদের খাওয়াতে পারতাম।

আব্দুল গনীর প্রতিবেশী হেমায়েত উদ্দিন নামে সমুদ্রগামী আরেক জেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সাগরে যারা মাছ শিকার করি তারা প্রায় সবসময়ই আর্থিক সমস্যার মধ্যে থাকি। সাগরে মাছ কম, এছাড়া এখন চলছে মাছ শিকারে অবরোধ। আমাদের হাতে টাকা পয়সা নেই। কোরবানির সময়ে যদি কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেতাম তাহলে কোরবানির দিন ছেলে-মেয়েকে একবেলা গোস্ত কিনে খাওয়াতে পারতাম।

বরগুনা সদর উপজেলার আরেক জেলে ওদুদ খান গভীর সমুদ্রের মাছ শিকার করলেও সরকারি তালিকায় নাম নেই তার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পরিবার নিয়ে আমি খুবই কষ্টে আছি। সাগরে মাছ শিকার করলেও আমার নাম নেই গভীর সমুদ্রের জেলে  তালিকায়। এ কারণে সরকারি বরাদ্দের চালও আমি পাই না। তারপরেও চাল দেওয়ার সময়ে ইউনিয়ন পরিষদে দুইবার গিয়েছি, কিন্তু তালিকায় নাম না থাকায় আমাকে চাল দেওয়া হয়নি। সাগরে মাছ শিকার করা ছাড়া আমার আর কোনো আয় নেই। এখন কোরবানিতে পরিবার নিয়ে যে দুই কেজি গোস্ত কিনে খাব এমন সুযোগও আমার নেই।

প্রকৃত সমুদ্রগামী জেলেদের নামের তালিকায় নাম না থাকা ও তালিকার হালনাগাদের বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার  শামীম মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সদর উপজেলায় সমুদ্রগামী ও নদীতে মাছ শিকার করে এমন প্রায় ১০ হাজার জেলে তালিকাভুক্ত আছেন। তবে তালিকায় নাম না থাকার বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময়ে অনেকেরই অভিযোগ পেয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে যে কমিটি আছে তাদের সভার মাধ্যমে প্রকৃত জেলেদের তালিকা প্রস্তুত করে আমাদের কাছে নিয়ে আসলে উপজেলা কমিটির মাধ্যমে তা হালনাগাদ করা হবে। এছাড়া এ তালিকা করার পরেও আমরা ১০ দিন সময় অপেক্ষা করব এ সময়ের মধ্যে যদি কারো অভিযোগ পাই তবে তা সমাধান করে চুড়ান্ত তালিকা করা হবে।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনায় প্রায় ২৭ হাজারের বেশি সমুদ্রগামী জেলে নিবন্ধিত রয়েছে। এখন সমুদ্রগামী জেলেদের মাছ শিকারের অবরোধ চলছে। এ সময়ে যারা নিবন্ধিত জেলে রয়েছে তারা দুই ধাপে মোট ৮৬ কেজি চাল পাবে। আমরা চেষ্টা করছি ভবিষ্যতে তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার। এ জন্য সরকারের কাছে আমরা একটি প্রস্তাবনা দিয়েছি। আমরা আশা করছি সরকার বিশেষ করে মৎস্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সে বিষয়ে কাজ করছেন। এছাড়া সকল জেলেকেই নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসতে বিভিন্ন কমিটিসহ উপজেলা কমিটি কাজ করছেন। সকল জেলেরা নিবন্ধনের আওতায় আসলেই তারা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসবে।

এছড়া কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে জেলেদের সহযোগিতার বিষয়ে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সরকারিভাবে ও বিভিন্ন এনজিও আর্থিক সহযোগিতার কাজ করছে। অনেক এনজিও জেলেদের নিয়ে কাজ করছে। আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। কিছু সংখ্যক জেলেরা সহযোগিতা না পেলেও জেলেদের মধ্যে অধিকাংশরাই অর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে। এছাড়া যে সকল এনজিও বিভিন্ন এলাকায় কাজ করে তাদেরকে আমরা বলেছি যাতে বিশেষ করে সমুদ্রগামী জেলেদেরকে তাদের কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসে।

আব্দুল আলীম/আরকে