পশুর হাটে অতিরিক্ত হাসিল আদায়, নীরব মান্দা প্রশাসন
নওগাঁর মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়া হাটে শুক্রবার (১৪ জুন) কোরবানির গরু কিনতে যান নিয়ামতপুর উপজেলার গয়েশপুর গ্রামের আবুল হোসেন। ৭০ হাজার টাকায় একটি গরু কেনার পর সরকার নির্ধারিত হাসিল ৫০০ টাকা দিতে গিয়ে ইজারাদারের প্রতিনিধিদের হুমকির মুখে পড়েন তিনি। জোরপূর্বক তার থেকে হাসিল আদায় করা হয় ৯০০ টাকা। আবার বিক্রেতার থেকেও লিখনি বাবদ নেওয়া হয় ১৫০ টাকা। তবে রশিদে লেখা হয়নি কোনও টাকার পরিমাণ।
একই সময়ে ওই হাটে ছাগল কিনতে আসা ক্রেতাদের থেকেও অতিরিক্ত হাসিল আদায় করছিলেন ইজারাদার আবুল বাশার সুজন। সরকার নির্ধারিত ২০০ টাকা হাসিলের বিপরীতে প্রত্যেক ছাগলে তিনি আদায় করছিলেন ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। দুপুরের পর থেকেই এসব অভিযোগ যাচ্ছিল উপজেলা প্রশাসনের কাছে। তবে বিষয়টি জেনেও নীরব ভূমিকায় ছিলেন মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লায়লা আঞ্জুমান বানু।
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ বিকেলে চৌবাড়িয়া হাটে ছুটতে হয় নওগাঁ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাকিব বিন জামান প্রত্যয়কে। অতিরিক্ত হাসিল আদায়ের সত্যতা পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাকিব বিন জামান প্রত্যয়। হাট ইজারাদারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়াও অতিরিক্ত হাসিল আদায় না করতে ইজারাদারকে সাবধান করে দেন আদালত।
অতিরিক্ত হাসিল আদায়ের বিষয়ে চৌবাড়িয়া হাটের ইজারাদার আবুল বাশার সুজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোরবানির ঈদের আগে হাটে যে পরিমাণ গরু-ছাগলের আমদানি হয়, সারা বছর তার অর্ধেকও হয় না। অনেক টাকা খরচ করে হাট ইজারা নিয়েছি। শেষ মুহূর্তে এসে কিছু অতিরিক্ত হাসিল আদায় করতে না পারলে লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে। তাই কিছু টাকা বেশি নিয়েছি। লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে হাসিল আদায়ের অভিযোগটি সঠিক নয়।
অতিরিক্ত হাসিল আদায়ের অভিযোগ পাওয়ার পরেও কেন নীরব ভূমিকায় ছিলেন মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লায়লা আঞ্জুমান বানু, জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক অভিযোগই আসছিল। আমার মনে হয়েছে বিষয়টি ডিসিকে (জেলা প্রশাসক) জানানো দরকার। আমি স্যারকে অবগত করেছি। পরে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে জরিমানা করেছেন। এখানে উপজেলা প্রশাসনকে কোনও পক্ষ প্রভাবিত করছে না বলেও দাবি করেন তিনি।
কোরবানির পশুর হাটের এই চিত্র শুধুই মান্দার চৌবাড়িয়া হাটের নয়। ঈদুল আযহার আগে প্রতি বছরই নওগাঁর সব পশুর হাটের ধারাবাহিক চিত্র এটি। সরকারিভাবে প্রতিটি গরুতে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা এবং ছাগলের জন্য সর্বোচ্চ ২০০ টাকা হাসিল আদায় নির্ধারণ করা থাকলেও প্রতিটি গরুতে ৭০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা এবং প্রতিটি ছাগলে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা করে হাসিল আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া লিখনিতে গরু বিক্রেতার থেকে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা এবং ছাগল বিক্রেতার থেকে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
প্রতিটি পশু ক্রেতা-বিক্রেতাদের থেকে এভাবে অতিরিক্ত হাসিল আদায় করা হলেও তাদের দেওয়া বেশিরভাগ রশিদে টাকার কোনও পরিমাণ উল্লেখ নেই। অতিরিক্ত হাসিল আদায়ের প্রতিবাদ করলেও কর্ণপাত করছেন না ইজারাদাররা। উল্টো হাটে দায়িত্বে থাকা এক বিশেষ লাঠিয়াল বাহিনীকে দিয়ে ক্রেতাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অভিযোগ করলেও মিলছে না তাৎক্ষণিক প্রতিকার। জেলার ১১টি উপজেলার ছোট-বড় ৩৮টি পশুর হাটে প্রকাশ্য এই অনিয়ম চললেও বিষয়টি জেনেশুনে নীরব ভূমিকায় রয়েছেন উপজেলা প্রশাসনের সিংহভাগ কর্মকর্তারা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন তারা।
কেন এই নীরবতা সেটি অনুসন্ধানে গেলে ইজারাদারদের এ সিন্ডিকেটে স্থানীয় সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আসতে থাকে প্রতিবেদকের হাতে। সম্প্রতি মান্দা উপজেলার জোকাহাটে খাসি কিনে হাসিল দিতে গেলে ক্রেতা ওমর ফারুকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন ইজারাদার আরিফুল ইসলাম। তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত হাসিল দাবির বিষয়টি জেলা প্রশাসককে মুঠোফোনে অবগত করেন ওমর ফারুক। ওই মুহূর্তে জেলা প্রশাসক ফারুকের মুঠোফোনে ইজারাদারের সঙ্গে কথা বলতে চান। তবে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেয় ইজারাদার আরিফুল ইসলাম। আরিফের বক্তব্য, ডিসির কিছু জানার হলে গামা ভাইয়ের (মান্দা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্রহানী সুলতান মামুদ গামা) সাথে কথা বলুক।
অতিরিক্ত হাসিল আদায়ে আদৌ পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে কিনা মান্দা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্রহানী সুলতান মামুদ গামার, জানতে জোকাহাটের ইজারাদার আরিফুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১২ লাখ টাকায় এই হাট ইজারা নিয়ে গত কয়েক হাটে মাত্র আড়াই লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছি। যাতে লোকসান না হয় সেজন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি টাকা আদায় করতে হয়েছে। তবে অনেককে ছাড়ও দিয়েছি। যেহেতু গামা ভাইয়ের ভোট করেছি তাই ওইদিন ভুলে এমপির নাম মুখে চলে এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মান্দা-৪ আসনের সাংসদ ব্রহানী সুলতান মামুদ গামার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাট বাজারগুলো নামেই ব্যবসায়ীদের নামে ইজারা হয়। প্রকৃত অর্থে বেশিরভাগ হাটই স্থানীয় সাংসদদের ঘনিষ্ঠজনরা পরিচালনা করেন। এই কারণেই অতিরিক্ত হাসিল আদায় ঠেকানো যাচ্ছে না। ইউএনওদের প্রভাবিত করা হচ্ছে। তাই এ সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় উপজেলা প্রশাসন। অথচ জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট গেলেই জরিমানা গুনছে ইজারাদাররা।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক গোলাম মওলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পশুর হাটে সরকার নির্ধারিত হাসিলের চেয়ে বেশি আদায় করার সুযোগ নেই। প্রতিনিয়ত হাটগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে তাৎক্ষণিক জরিমানা করা করছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এরপরও ইজারাদাররা অতিরিক্ত হাসিল আদায় করলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরমান হোসেন রুমন/পিএইচ