নেপিয়ার ঘাস খেয়ে একটি খামারের ২৭টি গরু মারা যাওয়ার ঘটনায়, ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় তিন সদস্যের একটি বিশেষ দল নেত্রকোণার পূর্বধলায় অনুসন্ধান শেষ করেছে। শুক্রবার (১৪ জুন) সকাল ১০টার দিকে এ বিশেষ দল খামারটিতে তাদের তদন্তের কাজ শুরু করেন। খামার পরিদর্শন, তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও তারা বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছেন। গরুর পাশাপাশি মানুষের মাঝে যেন কোনও ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ না ঘটে সেটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় নিয়ে তারা কাজ করেছেন।

বিশেষ এ দলে রয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এফএটিপিভি ফেলো ডা. মানসুরুল হক। রোগতত্ত্ব রোগ গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফিল্ড এপিডেমিওলজি ট্রেনিং ফেলো ডা. সাকিয়া হক। এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এপিডেমিওলজি বিভাগের ন্যাশনাল টেকনিক্যাল এডভাইজর ডা. তায়ফুর রহমান।

তারা বলছেন ঘটনাটি সহজভাবে দেখার সুযোগ নেই। সেজন্য আমার তিন অধিদপ্তরের স্পেশালিস্টরা এসেছি মূল ঘটনা কী, সেটা উদঘাটনের জন্য।

এদিকে তাহাযিদ অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক জাহেরুল ইসলাম বলছেন, এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, সাতদিন পার হতে চলল কিন্তু এখনো পর্যন্ত গরুগুলো মারা যাওয়ার কারণ কী এটাই তারা বের করতে পারছেন না।

তিনি আক্ষেপ নিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মূলত যেটা করি, সারা বছর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাকিতে খাবার নিয়ে আসি। তারা মূলত ছোট ছোট ব্যবসায়ী। তারা সারা বছর আমাদেরকে বাকিতে খাবারগুলো দিয়ে সহযোগিতা করে। আমরা কোরবানিতে গরুগুলো বিক্রি করে তাদের সারা বছরের পেমেন্টটা করে থাকি। এখন এই গরুগুলো মারা যাওয়াতে আমার অনেকগুলো টাকা এখানে আটকে গেছে। এতে সব মিলিয়ে আমার আনুমানিক ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তাদের টাকাগুলো এখন আমরা দিতে পারবো না। পাশাপাশি মারা যাওয়ার পরও বিক্রয় উপযোগী যে গরুগুলো আছে, সেগুলো আমি বিক্রি করতে পারছি না।

আমার খামারে এখনও প্রায় ২০টির উপরে বিক্রির উপযোগী ষাঁড় গরু আছে। এগুলো যদি আমি বিক্রি করতে পারতাম, তাহলে হয়ত আমার এই খামারটি চালিয়ে নিতে পারতাম। তারপরে যদি সরকার থেকে কোনও সহযোগিতা করে সেটা পরের বিষয়। কিন্তু এখন তো আমি এই গরুগুলোকে না খাইয়ে রাখতে পারবো না। যারা খাবার সাপ্লাই দেয় তারাও তো এখন আমাকে সাপোর্ট দিতে পারবে না। কারণ তারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তাদের পুঁজি কম।

নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এখন আমার যে অবস্থা, টিকে থাকতে হলেও আমার সুস্থ গরুগুলো বিক্রি করে এই খামারটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখন বিক্রির উপযোগী গরুগুলো আছে সেগুলো পুরোপুরি সুস্থ আছে। কিন্তু, এখনও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে যারা এসেছেন, তারা আমার সুস্থ গরু এবং অসুস্থ গরু দুই ধরনের গরুকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন ও স্যম্পল নিচ্ছেন। যার জন্য আমি এগুলোকেও বাজারে নিতে পারছি না। এখানে তাদের একটা তদন্তের বিষয় আছে। পরে যেন অন্য কোথাও এমন সমস্যা না হয়। কিন্তু শুক্রবার সারাদিন চলে গেল তাদের তদন্তে! বাকি রইল শনি ও রোববার। এই দুই দিনে আমি বাজারে এগুলো বিক্রি করতে পারব কিনা জানি না। যদি বিক্রি করতে না পারি তাহলে সেটা আমার জন্য বড় একটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তখন খামার টিকিয়ে রাখাই দায় হবে।

খামারের এআই টেকনিশিয়ান শফিকুল আজাদ রিয়েল বলেন, এক একটা গরুর দাম দুই থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত। গরু অসুস্থ হয়েছে প্রায় সাত দিন। এখন পর্যন্ত কোনও টেস্টের রিপোর্টও আসেনি। আমরা যা চিকিৎসা করছিলাম, ঢাকা থেকে টিম আসছে শুনে সেটাও বন্ধ রাখছি। কিন্তু এখন দেখছি তারা এসে তদন্ত করছেন। তাহলে আমার গরুর চিকিৎসা হবে কখন। আমি মনে করি প্রত্যেক উপজেলায় একটা করে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম থাকা উচিত। যারা তাৎক্ষণিক একটা চিকিৎসা দিতে পারবে। কিন্তু আমাদের এখানে যে কটি গরু আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সবকটি গরু মারা গেছে। কোনও চিকিৎসাই হয়নি এই সাত দিনে। চিকিৎসার মধ্যে শুধু স্যালাইন দেওয়া হয়েছে।

পূর্বধলা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এম.এম.এ আউয়াল তালুকদার বলেন, আমি যখন শনিবার বিকেলে মেসেজ পাই তখনই আমাদের মেডিকেল টিম এখানে পাঠিয়ে দিই। তারা এখানে আসার পরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তখন আমরা তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করি। কথা বলে জানতে পারি, তারা সাধারণত শুধু ঘাস খেতে দিতেন না, শুকনো খড়ের সাথে মিশিয়ে দিতেন। কিন্তু এবার কাঁচা ঘাস দেওয়ার কারণে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। আমরা কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছি, যেমন খাবার ও রক্ত। আমরা এগুলো ঢাকাতে পাঠিয়েছি পরীক্ষা করার জন্য। রিপোর্ট আসলে ঘটনার বিস্তারিত জানা যাবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এফএটিপিভি ফেলো ডা. মানসুরুল হক বলেন, মূলত যে ঘটনাটা ঘটেছে আমরা সেটার কারণ খুঁজে বের করতে এসেছি। আমরা যদি কারণটা খুঁজে বের করতে পারি তাহলে পরে এ ধরনের সমস্যা আর হবে না। আমরা এটা মাথায় রেখেই ইনভেস্টিগেশন করছি। ইনভেস্টিগেশন শেষ হওয়ার পর ল্যাবরেটরী অ্যানালাইসিস করবো। আমরা ব্লাড স্যাম্পল নিচ্ছি, ইউরিন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব সংগ্রহ করছি। সেগুলো নিয়ে অ্যানালাইসিস করব, আশা করছি এরপরে কিছু একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে। যেটা সবার উপকারে আসবে।

অসুস্থ গরুগুলোকে কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে? ঢাকা পোস্টের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা এখনও ইনভেস্টিগেশন শেষ করতে পারিনি। আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। তারপর হয়ত আমরা একটা রিকমেন্ডেশন দিতে পারব।

তদন্তের রিপোর্ট বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ল্যাব এনালাইসিস শেষ হতে কত সময় লাগবে, এটা এখন সঠিক বলা যাচ্ছে না। কারণ সামনে ঈদ, ল্যাব ফেসিলিটির একটা বিষয় আছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করব সর্বোচ্চ দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন আমরা আমাদের প্রতিবেদন দিতে পারি। আসলে চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।

সংক্রমণ বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফিল্ড এপিডেমিওলজি ট্রেনিং ফেলো ডা. সাকিয়া হক বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত পরিদর্শন করে যতটুকু বুঝলাম, এ খামারটিতে সংক্রমণের ঝুঁকিটা কম। আমরা এখান থেকে ঘাস থেকে শুরু করে সব ধরনের স্যাম্পল কালেক্ট করেছি। এগুলোর পরীক্ষার রেজাল্ট আসলে পরে হয়ত কিছু বোঝা যাবে। যেহেতু গরু থেকে গরুতে ডিজিজটা ছড়ায়নি, পাশাপাশি খামারের কাজ করা মানুষদেরও কোনও অসুস্থতার সিম্প‌টম নেই তাই এখানে সংক্রমণের ঝুঁকিটা কম। প্রাথমিক পর্যায়ে সংক্রমণের ঝুঁকি কম মনে হচ্ছে। তবে ফাইনাল রেজাল্ট আসলে পরে বিস্তারিত জানা যাবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এপিডেমিওলজি বিভাগের ন্যাশনাল টেকনিক্যাল এডভাইজর ডা. তায়ফুর রহমান বলেন, আমাদের এখনও অনুসন্ধান শেষ হয়নি। এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও কিছু বলতে পারছি না। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে ল্যাবরেটরি রিপোর্টের ওপর। আমরা যেটা করতে পারি, এখন যা হয়ে গেছে, এটা যেন আর না হয়, সেটার জন্য আমরা যেন একটা পদক্ষেপ নিতে পারি। আমরা আশা করছি এই রোগটা আর বাড়বে না। আমরা লাইভস্টক অফিসারকে সাথে নিয়ে খামার মালিকের সাথে কথা বলেছি এবং অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসার বিষয়টা উপজেলা লাইভস্টক অফিসার দেখবেন। আমরা মূলত অনুসন্ধান করতে এসেছি। আমরা এখন স্যাম্পল নিয়ে রাতেই ঢাকায় যাচ্ছি। এগুলো রাতেই ল্যাবরেটরীতে জমা দেওয়ার চেষ্টা করব।

তিনি আরো বলেন, সত্যি বলতে আমরা এখনও এতগুলো গরু মারা যাওয়ার আসল কারণটা খুঁজছি। আমাদের অনেকগুলো টেস্টের বিষয়ে আছে, সেই টেস্টগুলো করার পর হয়ত আমরা একটা সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে পারবো। আমরা এ ঘটনাটাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নিয়েছি। আমাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নাই, আমরা সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি। এখন পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে পরবর্তীতে কী হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার ৮ জুন থেকে ১২ জুন পর্যন্ত নেত্রকোণার পূর্বধলায় তাহাযিদ অ্যাগ্রো ফার্ম নামের একটি খামারে নেপিয়ার ঘাস খেয়ে ২৭টি গরু মারা যায়। খামার মালিক ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ধারণা করছিলেন, ঘাসের নাইট্রেট বিষক্রিয়ায় ফুড পয়জনিংয়ের কারণে এই গরুগুলো মারা গেছে। তবে কেউই মারা যাওয়ার আসল কারণ জানতেন না।

চয়ন দেবনাথ মুন্না/পিএইচ