দুদিন পরেই পবিত্র ঈদুল আজহা। পশু কোরবানি দেবেন সামর্থ্যবানরা। শেষ মুহূর্তে পাবনার হাটগুলোতে জমে উঠেছে কোরবানির পশু বেচাকেনা। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে পশু আসছে হাটগুলোতে। সব মিলিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতায় কানায় কানায় পূর্ণ পশুর হাট। ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে চলছে দর-কষাকষি ও বেচাকেনা। তবে হাটে মাঝারি আকারের গরুর চাহিদা বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।

শুক্রবার (১৪ জুন) বিকেলে পাবনা শহরতলীর হাজির হাটে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হাটে প্রচুর গবাদিপশু উঠেছে। যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ী ও খামারিরা ট্রাক, মিনিট্রাক, নছিমনসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে হাজার হাজার গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও গাড়ল নিয়ে এসেছেন। হাটে জায়গা না হওয়ায় রাস্তার উভয় পাশে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে পশুরহাট বসেছে। আবার অনেককেই পশু ফেরত নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

সদরের মালিগাছার টেবুনিয়া থেকে গরু নিয়ে হাটে এসেছেন ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ৪টি ফ্রিজিয়ান জাতের বড় গরু হাটে নিয়ে আসছি। হাটে গরুর অনেক আমদানি হয়েছে। কিন্তু কেনাবেচা তেমন হচ্ছে না। দেশি ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি। দাম মোটামুটি ভালোই।

পাবনা সদরের দুবলিয়ার দাসপাড়া থেকে হাটে আসা সিহাব মল্লিক বলেন, ২টি গরু নিয়ে আসছি। ৮/৯ মণ ওজনের গরু। দাম বলে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ গরুর দাম না হলেও ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হবে। এতো কম দামে গরু বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে। গো-খাদ্যের যে পরিমাণ দাম বেড়েছে সে অনুযায়ী দাম পাচ্ছি না। এক বস্তা গমের ভুসির দাম ছিল ১ হাজার টাকা করে। বর্তমানে ২ হাজার ২০০ টাকা করে কিনতে হচ্ছে।

জালালপুরের রবিউল ইসলাম বলেন, সকালে ৬টি ছোট ও মাঝারি গরু নিয়ে হাজির হাটে আসছি। সব কয়টিই বিক্রি হয় গেছে। বড় গরুর চাহিদা খুবই কম। বড় গরুর অনেক দাম কম। আর ছোট গরুর দাম বেশি। সব মিলিয়ে দাম স্বাভাবিক রয়েছে। 

আটঘরিয়ার পাটেশ্বরের জিয়াউর বলেন, ৫টি গরু নিয়ে খুব সকালে হাটে আসছি। সারাদিনে মাত্র একটা বিক্রি করা গেছে। খুব লোকসানে আছি। এমন বাজার থাকলে বাড়ি-ঘর ছাড়তে হবে। পথে বসতে হবে। ভুসির দোকানে ১ লাখ টাকা বাকি আছে। গরু বেচাকেনা না হলে জমি বিক্রি করে দোকান বাকি পরিশোধ করতে হবে।

হাটে আসা সুজানগরের খামারি আফজাল হোসেন জানান, তার খামারের সবচেয়ে বড় ষাঁড় গরুটির দাম হাঁকিয়েছিলেন ৬ লাখ টাকা। হাটে নিয়ে এলেও কোনো ক্রেতা নেই। স্থানীয় কিছু ক্রেতা ও ব্যাপারী দাম বলছে ৩ লাখ টাকা। গরু আজকেও বিক্রি করতে পারেননি। আগামীকাল ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতেন।

আজিজুল হাকিম নামে একজন কৃষক বলেন, তিনটি গরু হাটে তুলেছিলাম। প্রতিটির দাম চেয়েছিলাম পৌনে চার লাখ টাকা। অথচ ব্যাপারীরা গড়ে প্রতিটি গরুর দাম বলেছে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা। উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে গরু তিনটি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

আতাইকুলা থেকে আসছেন রোকন আলী। তিনি বলেন, কৃষকের বাড়ি থেকে এ বছর ১০০টির মতো গরু কিনেছি। কিছু গরু ঢাকার হাটে পাঠিয়েছি। আবার কিছু গরু পাবনার বিভিন্ন হাটে বিক্রি করছি। বাড়ির ওপর থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে আসছি। হাটে সে অনুযায়ী দাম নেই বললেই চলে। এখন আমাদের এগুলো করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে তাই করি। আহামরি এতো লাভ নেই।

হাটে গরু কিনতে আসা পাবনা শহরের শালগাড়িয়া মহল্লার মো. আসাব উদ্দিন বলেন, মাঝারি আকারের একটি গুরু ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনলাম। মাংসের জন্য কিনি নাই। আল্লাহর খুশিই প্রথম কথা। আমাদের কাছে বাজারে গরুর দাম বেশিই বলে মনে হচ্ছে। 

সদর উপজেলার দোগাছী ইউনিয়নের চর আশুতোশপুরের ছোট খামারি জহিরুল বাবু বলেন, ১০টির মতো মাঝারি গরু নিয়ে হাটে আসছিলাম। ৭টি বিক্রি করেছি। আর কয়েকটি আছে রাতের মধ্যে হয়ত বিক্রি হয়ে যাবে। একেবারে বেশিও যাচ্ছে না আবার কমও যাচ্ছে না। দাম মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। এ রকম দাম পেলে গরুকে খাওয়ানোর খরচ উঠবে, তবে লাভ হবে না। আমরা খামারে যে শ্রম দিয়েছি এটার দামও উঠবে না।

হাজির হাটের ইজারাদার ও হাট কমিটির সভাপতি রুহুল আমিন বিশ্বাস রানা বলেন, হাটে গরুর ব্যাপক আমদানি হয়েছে। কিন্তু বেচাকেনা তুলনামূলক একটু কম। আগামীকাল থেকে বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছি।  হাটে ব্যাপক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি মোড়ে মোড়ে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। 

পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার জানান, চাহিদার তুলনায় জেলায় এবার দ্বিগুণ কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। অতিরিক্ত পশুগুলো দিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদাও কিছুটা মেটানো সম্ভব হবে। পশুপালনে ব্যয় ও দামের ব্যাপারে তিনি বলেন, শুরু থেকেই এবার গোখাদ্যের দাম কিছুটা বেশি। এর ফলে পশু পালনে খামারিদের ব্যয়ও বেড়েছে। সেদিক থেকে ন্যায্যমূল্য না পেলে তারা লোকসানে পড়বেন। 

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, জেলায় এবার কোরবানির গবাদিপশুর সংখ্যা ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪১৪টি। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা ১ লাখ ৯৩ হাজার ১০০টি। এছাড়া ছাগল ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২০০, মহিষ ৮ হাজার ৩৪টি ও ভেড়া ৬৬ হাজার ৯১৬টি। জেলায় এবার কোরবানিতে চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার ৮২৬টি। উদ্বৃত্ত রয়েছে ৩ লাখেরও বেশি গবাদিপশু।

পাবনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী বলেন, কোরবানির পশুর হাটে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জেলা পুলিশ প্রতিটি হাটে পুলিশ মোতায়েন করেছে। নিয়মনীতি মেনে হাট পরিচালনা করতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিটি হাটে নজরদারি রয়েছে। হাটে জাল টাকা শনাক্তের জন্য টিম রাখা হয়েছে। 

পাবনার জেলা প্রশাসক মুহা. আসাদুজ্জামান বলেন, পাবনাবাসীর কোরবানির ঈদ নির্বিঘ্নে করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জাল নোট চিহ্নিত করতে মেশিন স্থাপন, হাট এবং মহাসড়কে পুলিশ টহল বাড়ানো, হাটে অতিরিক্ত হাসিল আদায় বন্ধসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 

রাকিব হাসনাত/আরএআর