বগুড়ায় আইএফআইসি ব্যাংকের বিমানমোড় উপশাখায় চুরির ঘটনা ঘটে

বগুড়ায় পাঁচ মাসে দুই ব্যাংকের প্রায় ৪০ লাখ টাকা চুরি হলেও তদন্তে তার কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া আরেক ব্যাংকে ডাকাতির চেষ্টা করা হয়, সেটার তদন্ত নিয়েও অন্ধকারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, আলোচিত এসব ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে না পারলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে।

যদিও পুলিশের দাবি, তারা স্পর্শকাতর এসব মামলা খুবই গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়েছেন। ঘটনার অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

এরই মধ্যে গত বুধবার (১৩ জুন) দিবাগত রাতে বগুড়া সদরের মাটিডালী এলাকায় অবস্থিত আইএফআইসি ব্যাংকের বিমানমোড় উপশাখায় ঘটে আরেকটি চুরির ঘটনা। এবার সিন্দুক কেটে চোরেরা নিয়ে যায় ২৯ লাখ ৪০ হাজার ৬১৮ টাকা। এ ঘটনায় পরদিন রাতে ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার নজরুল ইসলাম বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে।

ব্যাংক ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাত আড়াইটার দিকে ব্যাংকের ভবনটির ছাদের ইট ভেঙে দুইজন ব্যক্তি ভেতরে প্রবেশ করেছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দুইজনের গায়ে পলিথিন জড়ানো ছিল। তারা সিসি ক্যামেরা থেকে নিজেদের লুকাতে মুখের সামনে বেলচা ধরে চলাফেরা করে ব্যাংকের ভেতরে।

এ ঘটনার সঙ্গে সদরের এনআরবিসি ব্যাংকের উপশাখার চুরির ঘটনাটিও কিছুটা মিলে যায়। এনআরবিসির উপশাখাতেও ছাদের দরজা ভেঙে চোরেরা এসেছিলেন।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আড়াই বছর ধরে শাখারিয়া পল্লী মঙ্গলহাট এলাকায় একটি দুই তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় এনআরবিসি ব্যাংকের উপশাখার কার্যক্রম চলছিল। ওই বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় আরও একটি ফ্ল্যাটে এসকেএস এনজিও এবং একটিতে বাড়িওয়ালা থাকেন। দ্বিতীয় তলায় তিনটি পরিবার থাকে।

২৪ জানুয়ারি কাজ শেষে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাপ্তাহিক ছুটিতে চলে যান। কিন্তু রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় ঋণ আদায়ের জমাকৃত ৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা সিন্দুকে (ভল্ট) রাখেন তারা। এই সুযোগটাই নেয় দুর্বৃত্তরা। পরের দিন শুক্রবার (২৫ জানুয়ারি) রাতের কোনো এক সময় ব্যাংকের উপশাখাটিতে চুরির ঘটনা ঘটে। চোরেরা আগেই ব্যাংকের সিসি ক্যামেরা নষ্ট করেছিলেন। একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় চোরদের মুখ গামছা দিয়ে ঢাকা। শনিবার সকালে ওই ভবনের মালিক বিষয়টি বুঝতে পেরে পুলিশে খবর দেন। পরবর্তীতে এই উপশাখার ম্যানেজার রাশেদুল ইসলাম বাদী হয়ে সদর থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

জানতে চাইলে ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর হাসান বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দেওয়ার মতো কোনো আপডেট নেই। আমাদের চেষ্টা চলছে।

গত ২৭ মে রাতে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বগুড়ার কোথাও বিদ্যুৎ ছিল না। এই সুযোগে শিবগঞ্জ উপজেলার সোনালী ব্যাংকের শাখায় অন্তত ৪ জনের মুখোশধারী দল প্রথমে ব্যাংকের নৈশপ্রহরী আব্দুর রহমানের (৬০) হাত-পা ও মুখ বেঁধে পাশের একটি অফিস চত্বরে রাখে। পরে ডাকাত দল সোনালী ব্যাংকের প্রধান দুটি দরজার তালা ভেঙে দ্বিতীয় তলায় প্রবেশ করে। ব্যাংকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য নয়ন হোসেন (৩০) ও ফরহাদ হোসেনের (২৫) হাত, পা ও মুখ বেঁধে ব্যাংকের স্ট্রং রুমের হুইল ভেঙে ভল্ট রুমে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ভল্ট রুমে ঢুকতে না পেরে দুই আনসার সদস্যের কাছে থেকে মোবাইল ও আড়াই হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। এই সোনালী ব্যাংকটির ১০০ মিটারের মধ্যে থানা পুলিশের কার্যালয়। পরে ২৮ মে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন সিরাজী বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৩ থেকে ৪ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন।

এই ঘটনায় নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রবিউল ইসলাম। তার ভাষ্য, এই ডাকাতির চেষ্টা যেদিন ঘটেছে সেদিন ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিল। সব জায়গায় লোডশেডিং, মোবাইলের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন। আমরা সিসি ক্যামেরার কোনো ফুটেজ পাইনি। আমার এই মামলায় প্রকৃতঅর্থে অন্ধকারে আছি। ভরসা এখন আনসার সদস্যদের কাছে থেকে লুট হওয়া দুটো মোবাইল।

এসআই রবিউল ইসলাম বলেন, আমি প্রতিনিয়ত এটার খোঁজখবর রাখছি। ব্যাংকের প্রহরীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। হয়তো সময় লাগছে। কিন্তু ধরে ফেলব।

চুরি হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও

এর ঠিক দুই সপ্তাহ পর ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বগুড়ার টিএমএসএস মোবাইল মার্কেটের মিল্টন কুমার সাহার দোকানে চুরি হয়। এই মার্কেটের ৫০ মিটার পশ্চিমেই শহরের সদর পুলিশ ফাঁড়ি। মার্কেট ও ফাঁড়ির মাঝখানে ব্যবধান শুধু সড়ক।  পুলিশের দৃষ্টি সীমার দূরত্বে থাকা এই প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসায়ীর ৪০ লাখ টাকার মোবাইল চুরি হয়।

মামলা সূত্রে জানা যায়, টিএমএসএস মহিলা মোবাইল মার্কেটের ওই ব্যবসায়ীর নাম মিল্টন সাহা। মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় প্লাস মোবাইল ক্যাফে নামে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন তিনি। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এই প্রতিষ্ঠানের তালা ভেঙে মোবাইল নিয়ে যান চোরেরা। তিন দিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি বগুড়া সদর থানায় চুরির ঘটনায় মামলা করেন মিল্টন সাহা।

এজাহারে বলা হয়, ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিল্টন সাহা তার দোকান বন্ধ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে তার ভাই কমল সাহার কাছে দোকানে চুরির বিষয়ে খবর পান। খবর পেয়ে মার্কেটে গিয়ে দেখেন দোকানের একটি শাটার দরজা খোলা। ভেতরের সব মোবাইল উধাও। এতে ৪০ লাখ টাকার বিভিন্ন ব্রান্ডের ১৪০টি মোবাইল খোয়া যায়। এ ছাড়া নগদ ১৩ হাজার টাকাও চুরি করে দুর্বৃত্তরা।

মামলার তিন মাসের অধিক সময় ফুরালেও কোনো সুরাহা না পেয়ে এক প্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছেন মিল্টন সাহা। তিনি বলেন, কোনো কিছুই তো হচ্ছে না। কোনো অগ্রগতিও নেই। পুলিশ শুধু জানিয়েছে দুইজনের চেহারা বোঝা গেছে। কিন্তু তারা বাইরের হওয়ায় পরিচয় নিশ্চিত না। আমাকে নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন স্থানে গেছে পুলিশ। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। এখন আর ভালোও লাগে না তাদের সঙ্গে যেতে।

চুরির ঘটনায় অগ্রগতি না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। তবে কয়েকজনকে শনাক্ত করা হলেও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পুলিশের অভিযান চলছে।

এ ছাড়াও গত ২০ এপ্রিল সকালে বগুড়া নিউ মার্কেটের আল-তৌফিক জুয়েলার্স দোকানের তালা কেটে ১১০ ভরি স্বর্ণ চুরি করে নিয়ে যায় চোর চক্র। ঘটনার পরের দিন দোকানের মালিক কামরুল হোসেন সদর থানায় চুরির মামলা দায়ের করেন। ওই সময় দোকান মালিক দাবি করেন চোরচক্র ১১০ ভরি স্বর্ণ চুরি করেছে।

অবশ্য এ মামলায় সফলতা দেখিয়েছে পুলিশ। গত ৬ মে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে ইব্রাহিম ওরফে নয়ন সাহাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফিরোজশাহ কলোনি এলাকা থেকে মো. রুবেল ওরফে আঙ্গুল কাটা রুবেল (২৭) এবং কুমিল্লা থেকে মো. শাহজালালকে (৪৬) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় পুলিশ তাদের কাছ থেকে ১৭ ভরি ৮ আনা ৪ রতি স্বর্ণ ও ১টি বোল্ট কাটার উদ্ধার করে। 

পাঁচ মাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে চুরির ঘটনায় উদ্বিগ্ন জেলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা মনে করছেন, পুলিশের কার্যকরী ভূমিকা না থাকলে তা অপরাধীদের আরও বেশি উৎসাহী করে তুলবে।

বগুড়া জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব একটা ভালো না। শিক্ষিত বেকার বাড়ছে, সেখানে চুরি, ডাকাতি, খুন এসব অপরাধ বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু তো তৎপর থাকতে হবে।

তিনি বলেন, পুলিশ চাইলে সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু কেন এটা করতে পারছে না সেটাই বুঝি না। বরং তাদের দেখি সড়কে মোটরসাইকেল বা অন্য যানবাহন ধরা নিয়ে পড়ে রয়েছে। অবশ্য সেটারও দরকার আছে।

তুহিন বলেন, আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো যেখানে ব্যাংকের মতো আস্থাশীল প্রতিষ্ঠানে চুরি হয়, তার মাসের পর মাস কেটে গেলেও কোনো কূলকিনারা করতে পারে না পুলিশ। সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের নিরাপত্তা কোথায় থাকবে বা কে দেবে?

সার্বিক বিষয়ে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার) স্নিগ্ধ আখতার জানান, আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের চুরির ঘটনাগুলো একই রকম মনে হচ্ছে। একই চক্র করতে পারে। আবার আলাদা ব্যক্তিও হতে পারে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।

ক্লুলেস অপরাধের কারণে ঘটনাগুলো সমাধানে বেগ পেতে হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্লুলেস তো একটা শব্দ। যেহেতু রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি, এখানে একটু বেগ পেতেই হবে। আগেও তো অনেক কেসে আমরা সফল হয়েছি। আমরা এটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এতে আমাদের সময় লাগছে। তবে কোনো না কোনো সময় তো রহস্য বের হবেই।

আরএআর