সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১২ হাজার ৬৮৯ ভোট বাতিল হয়েছে। একটি উপজেলায় এমন ভোট বাতিলের ঘটনা নজিরবিহীন বলে দাবি করছেন ওই পদে কলস প্রতীকের পরাজিত প্রার্থী আফরোজা বেগম। তিনি পুনরায় ভোট গণনা করতে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাবরে আবেদন জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আনীত অভিযোগের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফলাফলের গেজেট প্রকাশ না করতে ও অন্যান্য কার্যক্রম স্থগিতের দাবি জানান তিনি।

আফরোজা বেগম বলেন, চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে যে ভোটের সংখ্যা দেখানো হয়েছে তাতে গরমিল রয়েছে। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১২ হাজার ৬৮৯ ভোট বাতিল দেখানো হয়েছে, যা নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। এটি দেশের ইতিহাসেও নজিরবিহীন। অথচ চেয়ারম্যান পদে ২ হাজার ২২৪ ভোট বাতিল হয়েছে। আমাকে পরাজিত করতে পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার ভোট বাতিল দেখানো হয়েছে। যা নিয়ে সাধারণ ভোটার ও মানুষের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আমি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ঘোষিত ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় ভোট গণনার দাবি করছি।

বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) সন্ধ্যা ৬টার দিকে রংপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আফরোজা বেগম এসব কথা বলেন। এ সময় বক্তব্যের একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। 

ভোট বাতিলের ব্যবধান তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনের সচিবসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনারগণ, অতিরিক্ত সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে বিষয়টি অবগত করেছেন বলেও জানান আফরোজা। 

লিখিত বক্তব্যে আফরোজা বেগম বলেন, গত ৫ জুন বদরগঞ্জ উপজেলার ১০৩টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে কলস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। ভোটের পূর্ব রাতে বিভিন্ন এলাকায় আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ফুটবল প্রতীকের রুবিনা আখতার টাকা বিতরণ করেছেন। তার ছেলে ও স্বামী, ছাত্রলীগ নেতা দাবি করা কয়েকজনকে দিয়ে ভোটারদের হুমকি দেন। ফুটবল প্রতীকে ভোট না দিলে এলাকা ছাড়ার ভয়ভীতি দেখায়। আমি প্রশাসনকে মৌখিকভাবে অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ভোটগ্রহণের দিন অর্থাৎ ৫ জুন সকাল ৭টা থেকে কুতুবপুর, গোপালপুর, মধুপুর, লোহানীপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে আমার নির্বাচনী এজেন্ট ও পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। আমি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র গিয়ে দেখি ভোটকক্ষে আমার কোনো পোলিং এজেন্ট নেই। আমার পোলিং এজেন্টদের প্রতিপক্ষের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেন। বিষয়টি দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশকে জানালে তারা কর্ণপাত করেননি। অনেক ভোটকেন্দ্রে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ফুটবল প্রতীকে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং ভোট গণণার সময়ও অনেক কেন্দ্রে আমার পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট গণণা করা হয়। ফুটবল প্রতীকের কর্মী-সমর্থক ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিজেই বিভিন্নভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন। বিষয়টি আমি অনকেবার প্রশাসনকে জানালেও তারা দেখছি দেখছি বলে কালক্ষেপণ করেন।

আফরোজা বেগম বলেন, ভোট গণনার পর ফলাফলে প্রকাশে বিলম্ব করা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে ভোট সংখ্যা বড়পর্দায় দেখানো হলেও সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোটের হিসাব এক ঘণ্টারও বেশি সময় দেখানো হয়নি। এ নিয়ে সাধারণ ভোটাররা উত্তেজিত হলে সার্ভার জটিলতার দোহাই দেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার। অথচ একই সময়ে চেয়ারম্যান পদে ভোটের ফল ঠিক দেখানো হয়। অনেক দেরিতে ফলাফল ঘোষণা করা হলেও সেখানে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১২ হাজার ৬৮৯ ভোট বাতিল দেখানো হয়েছে। যা নজিরবিহীন ঘটনা ও সন্দেহজনক। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী রুবিনা আখতার ফুটবল প্রতীকে ৩৬ হাজার ৭৭৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। আমি ভোট পেয়েছি ৩৪ হাজার ৯১৪টি। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী লিপি ইসলাম প্রজাপতি প্রতীকে পেয়েছেন ২৫ হাজার ৪১ ভোট।

তিনি আরও বলেন, বিপুল পরিমাণ ভোট বাতিলের ঘটনা সাজিয়ে আমাকে পরিকল্পিতভাবে পরাজিত দেখানো হয়েছে। আমি এবং সাধারণ জনগণ এতে খুবই মর্মাহত। এই ফলাফল নিয়ে পুরো উপজেলায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ভোট বাতিলের এই হিসাব কেউ মেনে নিতে পারছেন না। চেয়ারম্যান পদে দুই হাজার ভোট বাতিল হলেও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রায় ১৩ হাজার ভোট বাতিল অবিশ্বাস্যকর বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণে আমি পুনরায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট গণনার দাবি করছি। আমার বিশ্বাস সঠিকভাবে ভোট গণনা হলে জনগণের রায় আমার পক্ষে যাবে। 

এ সময় পুনরায় ভোট গণনা না হওয়া পর্যন্ত গেজেট প্রকাশসহ অন্যান্য কার্যক্রম স্থগিত করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানান আফরোজা বেগম।

প্রসঙ্গত, চতুর্থ ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে টানা তৃতীয়বারের মতো বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুইট। কাপ-পিরিচ প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৬১ হাজার ৫৯৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক হাসান তবিকুর চৌধুরী মোটরসাইকেল প্রতীকে পেয়েছেন ৪৫ হাজার ৭৫২ ভোট।

অন্যদিকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৬ হাজার ৭৭৫ ভোট পেয়ে ফুটবল প্রতীকের রুবিনা বেগম নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আফরোজা বেগম। তিনি কলস প্রতীকে পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৯১৪ ভোট। এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়  উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক রেজাউল করিম নির্বাচিত হন। বদরগঞ্জ উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নের ১০৩টি কেন্দ্রে গত ৫ জুন ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর