ফাইল ফটো

অবশেষে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন পেনশনের টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামের (৬৫) স্ত্রী তোহরা খাতুন (৪৫)।

বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) সকাল ১০টার দিকে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শিক্ষক নজরুল ইসলাম নিজেই তার স্ত্রী তোহরা খাতুনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আ ফ ম রিয়াজ উদ্দিন মানিক শিক্ষক নজরুল ইসলামের স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আসলে স্যারের বিষয়টা যখন উনার ফেসবুকে উনি পোস্ট করে, তখন এক বন্ধু আমাকে মেনশন করে কিছু করা যায় কিনা। আমি তারপর সবার সঙ্গে যোগাযোগ করি, এমপি মহোদয়কেও জানাই। উনি ঈদের ছুটির পরে নিজেই স্যারের জন্য কাজ করবেন বলে জানান। এরই মধ্যে স্যারের সহধর্মিণী মারা গেলেন। আসলে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছি না। শুধু বলব এভাবে যেন আর কোনো শিক্ষক ভোগান্তির শিকার না হয়।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্রীরামপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি এমপিও দাখিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। বছর চারেক আগে অবসরে যান এই শিক্ষক। শিক্ষক জীবনে তার হাতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়েছে। শিক্ষা দিয়ে তিনি অনেকের জীবনের পরিবর্তন ঘটালেও তার নিজের জীবন এখন চরম সংকটাপন্ন অবস্থায়। অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরে আজ পর্যন্ত পেনশনের টাকা পাননি। পেনশনের টাকা না পাওয়ায় চিকিৎসা বন্ধ হয়ে শয্যাশায়ী অসুস্থ স্ত্রী আজ মারা গেছেন। তার এক কন্যাও অসুস্থ। পেনশনের টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর।

সরেজমিনে গত ৮ জুন শিক্ষক নজরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অর্ধপাকা একটি টিনের ঘরের মধ্যে দুটি কক্ষ। একটি কক্ষে তার অসুস্থ স্ত্রী তোহরা খাতুন (৪৫) অপর কক্ষে অসুস্থ মেয়ে রুমা খাতুন (২৬) শয্যাশায়ী। তার স্ত্রী তোহরা খাতুন ছয় মাস ধরে শরীরের মাংস পচন রোগে ভুগে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। অপরদিকে মেয়ে রুমা খাতুন স্নাতক পাস করার পর গত চার বছর ধরে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী এবং মেয়ের ওষুধের টাকা জোগাড় করতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছোটাছুটি করতে হয় শিক্ষক নজরুলকে। আবার পেনশনের টাকার জন্য তাকে বার বার ধরনা দিতে হয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রতিষ্ঠানে। অবশেষে পেনশন না পেয়ে অর্থের অভাবেই বিনা চিকিৎসায় স্ত্রীকে হারালেন তিনি।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি ১৯৮২ সাল থেকে শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে বাঘারপাড়ার এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদরাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। সেখান থেকে গত ২০২০ সালের ২১ জুন অবসর গ্রহণ করেন শিক্ষক নজরুল। অবসরে যাওয়ার পর কল্যাণ তহবিলের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেলেও আজ পর্যন্ত পেনশনের একটি টাকাও পাননি তিনি।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অর্থের অভাবে আমার অসুস্থ স্ত্রী এবং মেয়ের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে আছে। তাদের প্রতি মাসে চিকিৎসা সেবার জন্য ১০-১৫ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। তাদের চিকিৎসা করানো তো দূরের কথা তিনবেলা ভাতের ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। বাঘারপাড়ার একটি এনজিওতে তিন হাজার টাকা বেতনে একটি চাকরি নিয়েছি। তাই দিয়ে আপাতত কোনোরকম ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি।

তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে, তারা যে যার মতো আলাদা থাকে। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি নিজেও সড়ক দুর্ঘটনার রোগী। আমার পরিবারে আমিহস তিনজন সদস্য আমরা তিনজনই রোগী। পেনশনের টাকার জন্য কয়েকবার ঢাকার ব্যানবেইসে গিয়েছি। সেখান থেকে আমার কাগজপত্র অস্পষ্ট বলে ফিরিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় যাওয়ার মতো অর্থও আর আমার নেই। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমার কাগজপত্রগুলো পুরাতন হয়ে যাওয়ায় ব্যানবেইস আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমি আকুতি মিনতি করলেও আমার পেনশনের টাকার কোনো ব্যবস্থা তারা করেনি। আমি সরকরারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আমার প্রতি একটু মানবিক দৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ করছি।

তিনি বলেন, আমার ছাত্র অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ-বিদেশে চাকরি করছে। কেউ আজ পর্যন্ত আমার খোঁজখবর নেয়নি। সম্প্রতি আমি ফেসবুকে লাইভে এসে আমার জীবন দশার কথা বললে, অনেকে যোগাযোগ করেছে, সহোযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু কেউ এখনো সহোযোগিতা করেনি।

বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও খানপুর দাখিল মাদরাসার সভাপতি সবদুল হোসেন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে নজরুল স্যার কিছু জানায়নি, আর আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।

যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার মাহফুজুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা জেলা শিক্ষা অফিসের আওতায় না। মাদরাসার বিষয়গুলো উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দেখাশোনা করেন।

বাঘারপাড়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা আশিকুজ্জামান বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামের বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কিছুই করার নেই। এটা ওই মাদরাসার সভাপতির সই-সাক্ষরসহ ঢাকা কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করতে হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।

এ্যান্টনি দাস অপু/আরকে