দেশের সর্বউত্তরের উপজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। এ উপজেলায় প্রায় ২ লাখ মানুষের বসবাস। এসব মানুষের চিকিৎসা সেবায় একমাত্র ভরসাস্থল ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে এ হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের কারণে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা। এ ছাড়া তেঁতুলিয়া শহর থেকে পঞ্চগড়ের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। জরুরি রোগীদের অনেক সময় এ পথ পাড়ি দিয়ে জেলা সদর হাসপাতালে নিতে হয়। সেখানেও পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীদের রেফার্ড করা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ততক্ষণে অনেক রোগীই যাত্রাপথেই মারা যান। এ ভোগান্তি আর শঙ্কা নিয়ে চলতে হয় তেঁতুলিয়ার লক্ষাধিক মানুষকে।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে ভিড় করেন। জরুরি বিভাগে আসেন ৫০ থেকে ১০০ জন রোগী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে বেশিরভাগ রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠানো হচ্ছে অন্য কোনো হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন ভর্তি হয়ে থাকেন আন্তঃবিভাগে। এরপরেও রোগীরা পর্যাপ্ত বেড না পেয়ে অনেক সময় বারান্দার ফ্লোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নেন। বিশেষ করে দুর্ভোগ পোহাতে হয় মা ও শিশু রোগীদের।

হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের কারণে বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন স্বাস্থ্য সহকারীরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও মেডিকেল অফিসার না থাকায় এদের দিয়েই বহির্বিভাগের চিকিৎসা চালানো হচ্ছে। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে রোগী আসলেই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় জেলা সদর হাসপাতালে। অবস্থার বেশি অবনতি হলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট থাকার কারণে তারা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। 

উপজেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, সদর হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যায় না। যার কারণে বাইরের ক্লিনিক থেকে ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে। সরকারি একটা হাসপাতাল থাকার পরও আমাদের ভোগান্তির শেষ নেই। আমাদের তো আর ক্লিনিকে ডাক্তার দেখানোর মতো সামর্থ্য নেই। 

পাথর শ্রমিক মামুন বলেন, জ্বর ও মাথাব্যথা নিয়ে তেঁতুলিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে কোনো মেডিকেল অফিসার পায়নি। একজন দেখে ওষুধ লিখে দিলেন। হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে দেখি মেয়াদ উত্তীর্ণ। পরে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যারকে জানালে তিনি সেই ওষুধ রেখে আমাকে অফিস সহকারীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দিয়েছেন।  

পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় প্রতিদিনেই ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগীদের। 

হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট, ফার্মাসিস্ট থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ নিয়ে সরকারি এ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসে নানান ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। তারা বলছেন, দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা হোক।

হাসপাতাল ঘুরে জানা যায়, ৫০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে ডাক্তারের পদ রয়েছে ২৮টি। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬ জন। এরমধ্যে তিনজন মেডিকেল অফিসার। এ ছাড়া জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) হিসেবে রয়েছেন ডাক্তার আফিফা জিন্নাত আফি ও ডেন্টাল সার্জন ডা.আনোয়ার হোসেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, মেডিকেল অফিসার, জুনিয়র কনসালটেন্ট ও সহকারী সার্জনসহ হাসপাতালটিতে পদ রয়েছে ২৮টি। কিন্তু ২৮ জনের স্থলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ মেডিকেল অফিসার আছে মাত্র ৬ জন। এরমধ্যে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) পদে একজন নিয়োজিত। বর্তমানে আবাসিক মেডিকেল অফিসারসহ মোট ২৩ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য। এর মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো), জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিও), জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (যৌন ও চর্ম) এবং সহকারী সার্জন (ইএমও), সহকারী সার্জন (প্যাথলজি), সহকারী সার্জন (এনেসথেসিয়া), এমও (হোমিও/আয়ুর্বেদিক) চিকিৎসকের পদ কয়েক বছর ধরে শূন্য রয়েছে। ফলে ২ জন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের পাশাপাশি ফার্মাসিস্ট দিয়ে জরুরি বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে।

এদিকে এ হাসপাতালটিতে আধুনিক অপারেশন থিয়েটার (ওটি) থাকলেও গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, এনেসথেসিয়া চিকিৎসক, সার্জারি চিকিৎসক না থাকায় অনেক অন্তঃসত্ত্বা রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বর্তমানে সিভিল সার্জন ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী পঞ্চগড়ে যোগদানের পর থেকেই এ উপজেলার গর্ভবতী প্রসূতি মাসহ সার্জারি রোগীর মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছে। গত নভেম্বর মাস থেকে তেঁতুলিয়া সদর হাসপাতালে এখন পর্যন্ত প্রতি মাসে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এ সিভিল সার্জন।

হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার মো. রাজিনুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রান্তিক এ উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসক সংকটের কারণে আমাদেরকে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরেও চেষ্টা করে যাচ্ছি রোগীদের নিরলসভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে। এর মধ্যে একজন চিকিৎসক যোগদান করেছেন। আশা করছি আগামীতে এ সমস্যা থাকবে না।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এএসএম রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ৫০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে চিকিৎসক সংকট রয়েছে এটা সত্য। আমি কয়েকদিন আগে যোগদান করেছি। হাসপাতালে বেশিরভাগ মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য থাকায় জরুরি ও বহির্বিভাগে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার দিয়ে যথাসাধ্য চিকিৎসা সেবা প্রদানে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে হাসপাতালে মেডিকেল অফিসারের পদায়ন চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পত্র দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ডা. ফারহান হোসেন হাসপাতালে যোগদান করেছেন। আর বহির্বিভাগে রোগীদের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ প্রদানের বিষয়টি দুঃখজনক। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর দায়িত্বরত ফার্মাসিস্টকে বদলি করা হয়েছে।

এসকে দোয়েল/এএএ