দীর্ঘ ৩৫ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি দাখিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন নজরুল ইসলাম (৬৫)। বছর চারেক আগে অবসরে যান তিনি। দীর্ঘ এ শিক্ষকতার জীবনে তিনি অনেকের জীবনের পরিবর্তন ঘটালেও তার নিজের পরিবার নিয়ে রয়েছেন চরম সংকটে। অবসরে যাওয়ার চার বছর পরও পাননি পেনশনের টাকা। এতে চিকিৎসা করাতে পারছেন না অসুস্থ স্ত্রী ও মেয়ের।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্রীরামপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক ছিলেন। 

সরেজমিনে শিক্ষক নজরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আধাপাকা একটি টিনের ঘরের মধ্যে দুটি কক্ষ। একটি কক্ষে তার অসুস্থ স্ত্রী তোহরা খাতুন (৪৫) অপর কক্ষে অসুস্থ মেয়ে রুমা খাতুন (২৬) শয্যাশায়ী। ছয় মাস ধরে তার স্ত্রী তোহরা খাতুন শরীরের মাংস পচন রোগে ভুগছেন। আর মেয়ে রুমা খাতুন স্নাতক পাস করার পর গত চার বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী ও মেয়ের ওষুধের টাকা জোগাড় করতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে ছোটাছুটি করতে হয় শিক্ষক নজরুলকে। আবার পেনশনের টাকার জন্য বারবার ধরনা দিতে হচ্ছে ঢাকা ব্যান বাইস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে।

নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি ১৯৮২ সাল থেকে শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে বাঘারপাড়ার এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদরাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। সেখান থেকে ২০২০ সালের ২১ জুন অবসর গ্রহণ করেন শিক্ষক নজরুল। অবসরে যাওয়ার পর কল্যাণ তহবিলের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেলেও আজ পর্যন্ত পেনশনের কোনো টাকা পাননি তিনি।

তিনি আরও বলেন, অর্থের অভাবে আমার অসুস্থ স্ত্রী ও মেয়ের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে আছে। তাদের প্রতি মাসে চিকিৎসার জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাদের চিকিৎসা করানো তো দূরের কথা তিনবেলা ভাতের ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ্যও নেই আমার। বাঘারপাড়ার একটি এনজিওতে তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছি। এ দিয়ে আপাতত কোনোরকমে বেঁচে আছি।

তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে, তারা যে যার মতো আলাদা থাকে। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি নিজেও সড়ক দুর্ঘটনার রোগী। পেনশনের টাকার জন্য কয়েকবার ঢাকার নীলক্ষেত ব্যান বাইস এ গেছি। সেখান থেকে আমার কাগজপত্র অস্পষ্ট বলে ফিরিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় যাওয়ার মতো অর্থও আর আমার নেই। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমার কাগজপত্রগুলো পুরাতন হয়ে যাওয়ায় ব্যান বাইস আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমি আকুতি মিনতি করলেও আমার পেনশনের টাকার কোনো ব্যবস্থা তারা করেনি। আমি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটু মানবিক দৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ করছি। 

শিক্ষক নজরুল ইসলামের প্রতিবেশী কাছেদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নজরুল মাস্টার অনেক সৎ মানুষ। আমাদের ছেলেমেয়েদের তিনি পড়িয়েছেন। আমরা কোনোদিন তার খারাপ দিক দেখিনি। এখন তিনি বিপদগ্রস্ত। তার বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রী ও মেয়ে রয়েছে। আমরা চাই দ্রুত তার পেনশনের টাকা তাকে দেওয়া হোক।

বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও খানপুর দাখিল মাদরাসার সভাপতি মো. সবদুল হোসেন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে নজরুল স্যার কিছু জানায়নি, আর আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।

যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. মাহফুজুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পেনশনের বিষয়টি জেলা শিক্ষা অফিসের আওতায় না। মাদরাসার বিষয়গুলো উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দেখাশোনা করেন।

বাঘারপাড়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামের বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কিছুই করার নেই। এটা ওই মাদরাসার সভাপতির সাক্ষরসহ ঢাকা কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করতে হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।

এ্যান্টনি দাস অপু/এএএ