>>মামলার ঘানি টানছেন দুই শতাধিক

>>বন উজাড় করতে মরিয়া প্রভাবশালীরা

>>ফুরিয়ে আসছে জনবসতির জমি

>>ঢালচরের আয়ু সর্বোচ্চ ৩০ বছর

‘পাঁচফির ভাঙ্গুলী হইয়া যহন দেখছি আর উপায় নাই তহন জীবনের মায়া ছাইড়া দিয়া বনের (বন বিভাগ) জমিতে ঘর তুলছি। যেহানে ঘর উডাইচি সেহানে বন নাই, গাছপালা নাই-চাইরদিক বালি। জোয়ারে ডুবি, ভাটিতে হুগাই (শুকায়)। খবর পাইয়্যা বন বিভাগ দুইডা মামলা দিয়া দিলো বাপ-পুতের বিরুদ্ধে। আষ্ট (আট) বৎসর ধইরা পুড়তেছি হেই মামলায়। আমগো একদিকে খায় নদী, আরেকদিকে খায় বন বিভাগের মামলায়।’

সকালে আকাশে রোদ তাতিয়ে ওঠার আগেই জাল ঠিক করতে গিয়ে ঘামে ভেজা শরীর গামছায় মুছতে মুছতে বলছিলেন ৫৬ বছর বয়সী রফিজাল ইসলাম মোল্লা। ঢালচর ইউনিয়নের মাঝেরচর মজিদের খালপাড় এলাকায় টিনের ঘর তার। ছেলে নজরুল ইসলাম নদী থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। তারও আফসোসের শেষ নেই।

নজরুল বলেন, ‘আব্বারে কতফির কইছি মেইনল্যান্ডে লন (চলেন)। দরকার পরলে মজুরি দিমু-ভিক্ষা করমু। তাও বনের মামলা খাইয়া জীবন শ্যাষ করতে পারমু না। আমরা গরিব-আমাগোতো জীবনেরও তো ভবিষ্যৎ আছে।’

‘তোর কতা মোডেও অয় না। চুপ যা। ভ্যাজর ভ্যাজর হরিস না।’ উত্তর দেয় রফিজাল মোল্লা।

তিনি বলেন, ‘মুই জানি বনের মামলা হইলো পয়জার। জীবন শ্যাষ কইরা দেয়—স্যার (প্রতিবেদক)। আমরাতো নিরুপায়। ওরা (ছেলে) বোঝে না। মেইনল্যান্ডে যাইয়্যা কি করমু? নদীর কাম ছাড়া আর কোনো কাম হিকছি?

শুধু যে রফিজাল ইসলাম ও তার ছেলে এমনই নয় ঢালচরে এভাবে ২০০ থেকে ২৫০ বাসিন্দা বছরের পর বছর মামলার ঘানি টানছেন।

বন জবরদখলের অভিযোগে পাঁচটি মামলার আসামি মাঝেরচরের বাবুল পাটোয়ারি। সেই মামলায় ইতোমধ্যে তিনবার কারাগারেও গিয়েছেন তিনি। বাবুল পাটোয়ারির অভিযোগ করে বলেন, রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতেই বন বিভাগকে ব্যবহার করে আমাকে মামলার আসামি করা হয়েছে। আমি মাঝের চরের চেয়ারম্যান বাজারে একটি ঘরে ভাড়া থাকি। ওখানে ব্যবসা করি। আমি বন বিভাগের এক হাত জমিও দখল করিনি। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে পরপর পাঁচটি মামলা দিয়েছে।

ঢাকা পোস্টকে বাবুল পাটোয়ারি বলেন, যাদের ঘরবাড়ি নদীতে নিয়ে গেছে তারা বন বিভাগের ফাঁকা স্থানে যেখানে গাছপালা নেই সেখানে ঘর তুলেছে। তাদের মামলার আসামি না করে আমাকে মামলার আসামি করেছে।

এদিকে চরবাসী বলছে, ঢালচরের উত্তর দিকে অব্যাহত ভাঙনে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, স্কুল, মাদরাসা, সাইক্লোন শেল্টার, সড়ক, বাসস্থান ভেঙে বিলীন হয়ে গেলেও একই চরের দক্ষিণে তারুয়া সমুদ্র সৈকত থেকে বঙ্গোপসাগর মাঝে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চর পড়েছে। এ ছাড়া বন বিভাগের আওতায় থাকা জমির পাশে শত শত একর গাছপালাহীন খালি পড়ে আছে। নতুন চর বা যেখানে গাছপালা নেই সেখানে ঘর তোলার অনুমতিও দিচ্ছে না বন বিভাগ। উল্টো বন উজার, জবরদখল, বন কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকির অভিযোগ এনে একের পর এক মামলা দায়ের করছেন।

বেশ কয়েকটি মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরফ্যাশন ও ভোলা মিলিয়ে বন বিভাগের করা ৩৫ থেকে ৪০টি মামলা রয়েছে ঢালচরের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে।

এসব মামলা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত চরফ্যাশনের এক আইনজীবীর সহকারী মোশারেফ হোসেন বলেন, চরফ্যাশনে ১৫টি আর ভোলায় দায়ের হওয়া সাতটি মামলা পরিচালনার সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত। এভাবে আরও অনেকের কাছে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। ঢালচরবাসী সারা বছর হাজিরা দিতে দিতেই তাদের রোজগারের সিংহভাগ খোয়ান।

মামলার আসামি ঢালচর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে জবরদখলের অভিযোগে মামলা দিয়েছে বন বিভাগ। অথচ যেখানে আমি ঘর তুলেছি সেখান থেকে আধা কিলোমিটার পূর্বে বন বিভাগের বন। আমি বনের কাছেও যাইনি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে সরাসরি আমি বন উজাড় আর জমি জবরদখলে অংশ নিয়েছি। অথচ তখন আমার একটি অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ছিলাম।

তিনি আরও বলেন, এভাবে ঢালচরের শত শত বাসিন্দা বন বিভাগের মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তার অধিকাংশরাই নদীভাঙনের শিকার। এদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে বন বিভাগের ফাঁকা জমিতে ঘর তুলছেন। তবে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছি, বন বিভাগের এমন হয়রানি বন্ধ করা হোক। ভাঙ্গুলী মানুষগুলোকে সরকার একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিক।

ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদীভাঙন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের সুযোগ রয়েছে। বন বিভাগের অনেক জমি আছে অব্যবহৃত পড়ে আছে। যেখানে বন নেই, গাছপালা নেই। সেখানে বন বিভাগ চাইলেই ভাসমান এই মানুষগুলোকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারে। কিন্তু বন বিভাগ তা হতে দিচ্ছে না। আমরা সরকারের কাছে দাবি করবো, ঢালচর, পূর্ব ঢালচর, চর নিজাম, বয়ারচর এলাকায় নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলোকে পুনর্বাসন করতে বন বিভাগের পরিত্যক্ত জমি ব্যবহার করতে দেওয়া হোক। নয়তো এই মানুষগুলোর যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা থাকবে না।

বসতিশূন্য করতে পরিকল্পনা

দুই দশক আগে শুরু হওয়া ভাঙনে ঢালচরের পূর্ব ঢালচর, পশ্চিম ঢালচর, চর সত্যেন, উত্তর ঢালচর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঢালচর দাখিল মাদরাসা, দুটি বাজার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়ণকেন্দ্র, বন বিভাগের রেঞ্জ ও বিট অফিস, মাছঘাট, পাঁচটি মসজিদ, দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক, গ্রামীণফোনের টাওয়ার, হ্যালিপ্যাড, আবাসন প্রকল্পের সাতটি ঘর, বিস্তৃত কৃষিজমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আরও তিনটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। এখানকার অনেক বাসিন্দা অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে নয়তো চর ছেড়ে চলে গেছে।

দিয়ারা জরিপের বরাত দিয়ে বন বিভাগ জানিয়েছে, ঢালচরের একটি অংশ চর সত্যেনে ৩২০০ হেক্টর জমি বন বিভাগের রিজার্ভ। যার মধ্যে ৩১০০ হেক্টর রেকর্ড হয়েছে। এ ছাড়া যে জমিতে বসতি ছিল তা ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে চর সত্যেনে জনবসতির জমি আর অবশিষ্ট নেই। যা আছে সবই বন বিভাগের। মূল ঢালচরের পূর্বপ্রান্তেও ৩৮ একরের মতো জমি ছিল বসতির, তাও ভেঙে গেছে। এ ছাড়া মাঝের চর, তারুয়া সৈকত ও ম্যানগ্রোভ বনাংশে সংরক্ষিত বন বিধায় জনবসতির কোনো সুযোগ নেই।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, নদীভাঙনের শিকার প্রায় দেড় হাজার পরিবার দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালচরের আবাদযোগ্য ২৭০০ একর জমি বন্দোবস্ত দাবি করে আসছিল সরকারের কাছে। তবে শুরু থেকেই বন বিভাগ বাধা দিয়ে আসছিল। পরে ভূমিহীনরা ১৯৮৬ সালে আদালতে মামলা করলে ২০১৯ সালে আদালত দোতরফা সূত্রে ভূমিহীন কৃষকদের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেওয়ার নির্দেশ দেন। রায় পেয়ে পরের বছর ভোলা জেলা প্রশাসক ২৭২৭ একর জমি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত প্রদানে প্রক্রিয়া শুরু করে। তবে  বন্দোবস্তের আওতায় আসা সেই জমিতে বসতি গড়তে গিয়ে বিপদে পড়েন ভূমিহীনরা। তাদের উচ্ছেদে আদালতের দ্বারস্থ হয় বন বিভাগ। এতে বিরোধপূর্ণ সৃষ্টি হওয়ায় চাষযোগ্য দেড় হাজারের বেশি জমি পরিত্যক্ত আছে।

ভূমিহীন রীণা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন বিভাগ এত মামলা-হামলা করে যেন গরিবে কিছু না পায় সেজন্য। তারা চাইতেছে ঢালচর বসতিশূন্য করতে। ভূমিহীনরা চলে গেলে তারা নিজেদের মতো ব্যবহার করতে পারবে। এজন্য আমাদের বিপদ মনে করে বন বিভাগ।

জেলে নাসির উদ্দিন বলেন, হাজার হাজার একর জমি খালি পড়ে আছে। নতুন চর জেগেছে। বন বিভাগ সেসব দখল করে বসে আছে। বন বিভাগের এত জমি লাগলে আমরা কোথায় যাব? আমরাতো কোনো জমি নিজের নামে রেকর্ড করাতে পারি না, বনের গাছ ধরি না। শুধু নদীর মাছ ধরে পরিবারসহ বেঁচে থাকব তার জন্য এই চরে থাকি। তাতেও সহ্য হচ্ছে না বন বিভাগের।

প্রভাবশালীদের ইন্ধন

ঢালচর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পর্যটনও হাতছানি দিচ্ছে। তাছাড়া সমুদ্রের মোহনায় সর্বশেষ বসতি হওয়ায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন। এসব কারণে প্রশাসনিক দুর্বলতা থাকায় বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী মহল তাদের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন ইতোমধ্যে। প্রভাবশালীরা প্রকৃত ভূমিহীনদের সামনে রেখে মূলত তাদের ফায়দা হাসিল করতে চাইছেন বলে মনে করেন উপকূলীয় বন বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তারা তাদের কাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। তারা ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, ঢালচরের বাসিন্দারা সারা বছরই নদী ও সাগরে মাছ শিকার করতে পারেন। এই সুবিধা নিতে হাতেগোনা ৪/৫ জন প্রভাবশালী বন বিভাগের মধ্যে বসতি স্থাপন করে দিয়ে হলেও জেলেদের রাখতে চাইছে ঢালচরে। প্রতি বছর ঢালচরে কয়েকশ কোটি টাকার মাছের ব্যবসা হয়। এ ছাড়া জমি দখল করিয়ে দিলে নিম্ন আয়ের জেলে পরিবারের কাছ থেকে ফায়দাও নেন তারা।

আরেক কর্মকর্তা জানান, ঢালচর পর্যটন সম্ভাবনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে সরকারি কয়েকজন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা চরের জমি জাল দলিল করে রিসোর্ট, পাকা স্থাপনাও গড়েছিলেন। কারণ এখানে সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে মালদ্বীপের মতো পর্যটন খাত বিকাশ হতে পারে। সেসব বুঝেই প্রভাবশালীরা ঢালচর দখলে রাখতে চাইছে।

সর্বোচ্চ ৩০ বছর আয়ু আছে ঢালচরের

বন বিভাগের মামলা আর ভূমিহীনদের শেষ গন্তব্য কোথায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বন বিভাগের ঢালচর রেঞ্জ কর্মকর্তা সুপল রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভূমিহীন-গৃহহীন চরবাসীর জন্য বন বিভাগ আন্তরিক। আমরা চরের অব্যবহৃত বন বিভাগের যে জমি আছে, যেখানে বন নেই গাছপালা নেই তা রিজার্ভ করার জন্য দুই দফায় প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। মানবিক বিবেচনায় এই প্রস্তাবনা আমরা পাঠাই। জেনে রাখা ভালো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। সুতরাং আমরা চাইলেই কাউকে প্রবেশ বা ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, ঢালচর যে গতিতে ভেঙে যাচ্ছে সেই ভাঙন অব্যাহত থাকলে সর্বোচ্চ ৩০ বছর থাকতে পারে এই ভূখণ্ডের অস্তিত্ব। এরপর হয়ত ঢালচরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে বিবেচনা করার অনুরোধ করবো, চরের বাসিন্দাদের যেন বিকল্প কোনো স্থানে পুনর্বাসন করা হয়। তাছাড়া মূল ভূখণ্ড থেকে এখানে যারা থাকেন তারা সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন।

এমজেইউ