‘আরেক চরে চইল্যা যামু, ঢালচরে থাকমু না’
‘সাত ভাঙুনি দিয়া এইখানে আসছিলাম। রেমালে সব নিয়া গ্যালো। খালি মানুষ কয়ডা বাঁইচ্যা ফিরছি। এহন ডিসিশন নিছি আরেক চরে চইল্যা যামু। ঢালচরে থাকমু না। ’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের বাসিন্দা জরিনা বেগম। চোখ ছলছল করছিল তার। কথাগুলো বলতে বলতে স্তব্ধ হয়ে যান। প্রায় ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে চরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন আসলেই কি তিনি পারবেন এবার তল্পিতল্পা গুটাতে?
বিজ্ঞাপন
পরের উত্তরেই স্পষ্ট করেন জরিনা। বলেন, ‘চরে থাকতে পারলে ভালো হইতো। এইহানে ঝড়-বইন্যা যা কাইড়রা লয়। হে ছাড়া হাঙ্গা বচ্চর মাছ-পোনা ধইররা মন্দ থাকি না। কিন্তু ভাঙনে ম্যাঘনা গলাঅব্দি চইল্যা আইছে। চরের দহিনে বন বিভাগের জমি। হেইহানে ঘর নেলে মামলার আসামি হওন লাগবে। হ্যার চাইতে চর ছাইড়ড়া যামু যে।’
জরিনা কান্না সংবরণ করতে পারেন না। তিনি জানেন অজানা গন্তব্যে পারি দিলে হয়তো বড় ঝড় এসে সব কেড়ে নেবে না, কিন্তু আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সর্বদক্ষিণের জনবসতি ঢালচর ইউনিয়ন। একদিকে মেঘনা, বুড়া গৌরাঙ্গ আরেকদিকে বঙ্গোপসাগর ঘিরে রেখেছে এই চরকে। দুই দশক আগেও প্রায় ১৭শ একর জমি নিয়ে বিস্তৃত ছিল এই চর। নদী ভাঙনে এই দুই দশকে যেমন কমেছে জমি, তেমনি কমেছে বসতির পরিমাণও। সড়ক, সাইক্লোন শেল্টার, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর ফসলি জমি সব চলে গেছে নদীগর্ভে।
ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, এত ঝড়-জলোচ্ছ্বোসের পরও থাকছি। কারণ আমাদের আয়ের উৎস নদী ও সাগর। ঢালচরে থেকে আমরা নদী ও সমুদ্রে মাছের খনির সন্ধান চালাতে পারি। অপরিসীম জলাধার হচ্ছে আমাদের কাছে খনিজ সম্পদের মতো। শুধু আমাদের প্রয়োজনই নয় দেশের যত ইলিশ আহরিত হয় তার উল্লেখযোগ্য ইলিশ আসে ঢালচরের জেলেদের জাল থেকে। এখানে থাকলে অন্তত বেঁচে থাকার মতো আয় রোজগার হয়।
তিনি বলেন, বছরের ১২ মাস নদীতে ইলিশ, চিংড়ি, বাগদা, গলদাসহ অনেক মাছ আহরণ করে থাকেন এখানকার জেলেরা। তুলনা করলে বছরের ছয় মাস ইলিশে পূর্ণ থাকে। বাকি ছয় মাস অন্য মাছ আহরণ করি। যাত্রাবাড়ি, কারওয়ান বাজার, বরিশাল পোর্ট রোড মৎস্য আড়ত, চাঁদপুরের ঘাটে যেসব মাছ যায় তার অধিকাংশ ঢালচরের জেলেদের জালের। আমাদের এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে তীব্র নদী ভাঙন। ২০০৩-০৪ সাল থেকে ভাঙন শুরু হয়ে অদ্যবধি চলছে। চারদিকের সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যে যে পারছে বসতি গুছিয়ে অন্য চরে চলে যাচ্ছে। আমরাও ঠিক কতদিন থাকতে পারব তা বলতে পারছি না।
আরও পড়ুন
ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মোস্তফা জানান, ১৯৭৪ থেকে এখন পর্যন্ত যত বন্যা হয়েছে সবগুলো ঢালচরে থেকেই নিজ চোখে দেখেছি। ১৯৯১ সালের বন্যায় দেখেছি চোখের সামনে পুরো পরিবারকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, আজো তাদের খোঁজ নাই। সিডর, আইলা, হামুন, মিধিলি এইসব ছোট ঘূর্ণিঝড়। এখনতো সিগন্যাল পাই। আগে কিছুই জানতাম না। হঠাৎ বাতাস, বৃষ্টি, নদীর ঢেউ এসে উড়িয়ে নিয়ে যেত। এখনো যখন বন্যা হয় তখন শুধু চোখের পানি ফেলা আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই থাকে না আমাদের। জীবনের মায়া ত্যাগ করে হলেও আমরা এখানে থাকি শুধু রুটি-রুজির সংস্থান আছে বলে।
তিনি বলেন, স্থায়ী প্রকল্প করে যদি চরটিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা যেত তাহলে মাছ আহরণকারীদের সুবিধা হতো। এখান থেকে সাগর ও নদী দুটোই কাছাকাছি। যে কারণে সারা বছরই মাছ ধরা যেত।
শুধু মৎস্য সম্পদই নয়, ঢালচরে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দেয় তারুয়া সমুদ্র সৈকত। ঢালচরের এই সৈকতে পর্যটকরা একই সঙ্গে উপভোগ করতে পারেন সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশি, পাখিদের কল-কাকলি, বালুকাময় মরুপথ, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ছায়াঘন মনকাড়া নিবিড় পরিবেশ।
তারুয়া সৈকতের একমাত্র রিসোর্টের কর্মকর্তা মো. হাসান বলেন, সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারুয়া সৈকত অন্যতম জনপ্রিয় সৈকতে পরিণত হতো। এই শীতেও কমপক্ষে ২০ হাজার পর্যটক এখানে এসেছিল। আমরা যতটুকু পারি তাদের সুযোগ-সুবিধা দেই। এই দ্বীপটি কুয়াকাটা, কক্সবাজারের মতই বড়। এর বিশেষত্ব হলো তারুয়া কৃত্রিমতা বর্জিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুন্দর।
গ্রাম পুলিশ মুসলিম মিজি বলেন, ঢালচরে দুটি বাজার। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য আনন্দ বাজার। এটি প্রতি সন্ধ্যায় জমে রাত ১১টায় বন্ধ হয়। এখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার দক্ষিণে মাঝের চরে চেয়ারম্যান বাজার। বাজারটি শুধু মাছের সিজনে চালু থাকে। প্রতিদিন হাজার হাজার টন মাছ এই বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। পাশাপাশি পর্যটন খাত বিকাশেরও সম্ভাুবনা রয়েছে। দরকার সঠিক উদ্যোগ।
ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম হাওলাদার বলেন, এখানকার বাসিন্দাদের ৯৮ শতাংশই জেলে। মাছ আহরণের বড় জায়গা ধরে রেখেছেন ঢালচর ও আশপাশের চরগুলোর জেলেরা। আমাদের জেলেদের আহরিত ইলিশই সারাদেশে যায় বিভিন্ন হাত ঘুরে। তবে জেলেরা ঝড়-বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিশেষ করে ঝড়ে তাদের ট্রলারগুলো কোথাও রাখার জায়গা নেই। এজন্য একটি খাল খননের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। ঢালচর দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছে প্রবল ভাঙনে। ভাঙন ঠেকানো গেলে মৎস্য আহরণ আর পর্যটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো এই চর।
চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নওরীন হক বলেন, ঢালচরের উন্নয়নের জন্য আমাদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা পাঠানো আছে। সেগুলোর অনুমোদন পেলে চরের উন্নয়নে কাজ শুরু করা হবে।
আরএআর