কথায় আছে ‘সাগরে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়’। ঠিক তেমনি লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীর পাড়ে বাস করে ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়াটা আকাশ-কুসুম চিন্তা। তবে দীর্ঘদিনের আন্দোলন আর উপকূলীয় বাসিন্দাদের আকুতিতে নদী শাসনে সরকার প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এ প্রকল্পে ৩২ কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধের কাজও চলমান রয়েছে। তবে কবে নাগাদ এ কাজ শেষ হবে তা নিয়েই যত জল্পনা-কল্পনা।

এদিকে নদীর অব্যাহত ভাঙন ছাড়াও একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ গিলে খাচ্ছে উপকূলের বহু মানুষের স্বপ্ন। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। তবুও তীর রক্ষা বাঁধের চলমান প্রকল্পটিকেই আঁকড়ে ধরে ‘সুখ’ খুঁজছেন উপকূলের বাসিন্দারা। কবে শেষ হবে নির্মাণ কাজ, কবে ফিরবে উপকূলে সুখ- সেই আশায় দিন গুনছেন স্থানীয়রা।

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে এই দুই উপজেলার তিনটি বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ব্লক দেবে যায়। এছাড়া নির্মাণাধীন বাঁধ ভেঙে উপকূলে জোয়ারের পানি ঢুকে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। জোয়ারের স্রোতের গতিও বেশি ছিল। বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রায় ১০০ কিলোমিটার। এছাড়া নদীর ঢেউ হার মানিয়েছে ৭০ এর মহাপ্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়কে। নদীর ঢেউ ঘরের চালার ওপর পর্যন্ত উঠেছে। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি- নদী তীরবর্তী এলাকার ঘরগুলোর ওপর দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। এছাড়া প্রায় ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস আতঙ্ক রেখে গেছে পুরো উপকূলজুড়ে। বসতঘর ও গাছপালা ভেঙে পড়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে ২০-৩০টি পরিবার।

২৬ মে রাতে খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানে। তবে তখন লক্ষ্মীপুরের উপকূলে শুধু ঝোড়ো বাতাসই ছিল। মেঘনার জোয়ারে নির্মাণাধীন মাটির বাঁধ ভেঙে উপকূলে পানি ঢুকে। পরদিন ২৭ মে সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে বিপদ সংকেত দেখাতে বলে উপকূলে। সরেজমিনে ওইদিন বেলা ১১টার দিকে কমলনগরের মাতাব্বরহাট এলাকায় গিয়ে মেঘনায় তীব্র ঢেউ দেখা যায়। বাতাসের গতিবেগ প্রায় ১০০ কিলোমটার ছিল। নদী তীরবর্তী এলাকায় স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দুপুর ১২টার দিকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। এক মিনিটের জন্যও বৃষ্টি থামেনি। একই সঙ্গে নদীতে তীব্র ঢেউসহ জোয়ারের পানি বাড়তে থাকে। জানা গেছে, দুপুর ২টার পর থেকেই রেমালের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস আর প্রবল বেগে বাতাস লক্ষ্মীপুরের উপকূলে তাণ্ডব চালায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ে রামগতি উপজেলার বড়খেরী ও আলেকজান্ডার বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থানে ব্লক দেবে ধস দেখা দেয়। এছাড়া কমলনগরের মাতব্বরহাট লঞ্চঘাটের পন্টুন তীব্র স্রোতে রাস্তায় উঠে পড়ে। এখানে বেড়িবাঁধে ধস দেখা দেয়। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো সংস্কার করেছে বলে জানা গেছে। কমলনগরের নবীগঞ্জ, নাসিরগঞ্জ ও ফলকনসহ বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা ভেঙে পড়েছে। ২০-৩০টি ঘর মেঘনার জোয়ার আর ঢেউয়ে ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। ঘরের ভিটা থেকে মাটি ধুয়ে নিয়ে যায় নদীতে।

কমলনগরের নাসিরগঞ্জ এলাকায় ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ জমির আলী হক ও ৭০ বছর বয়সী ইউছুফ মিয়ার সঙ্গে কথা হয় ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে। তারা জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় তারা ঘরেই ছিলেন। একপর্যায়ে ভয়ে ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হন তারা। আর ফিরে এসে তারা দেখতে পায় ঘরের বেড়ার টিনগুলো ছেঁড়াফাটা। ঘরের ভিটেতে মাটি নেই। ঘরে থাকা আসবাবপত্র কিছুই খুঁজে পাননি তারা। 

তাদের দাবি, তারা ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় দেখেছেন। কিন্তু রেমালের তাণ্ডব ৭০ এর ঘূর্ণিঝড়কেও হার মানিয়েছে। প্রায় ৫ ফুট জলোচ্ছ্বাস ছিল এবার নদীতে। একেক ঢেউ ঘরের চালার ওপর পর্যন্ত উঠেছে। বাতাসের তীব্রতায় নদী এলাকায় বসে থাকাও কষ্টের ছিল। মেঘনার ভাঙন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের মানুষের মাঝে সুখ নেই। বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। যদি কাজ শেষ হয় তাহলে মানুষের মাঝে সুখ ফিরে আসবে।

উপকূলে গিয়ে শিশু জিহান, রাশেদ, ওমর ফারুকসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে জলোচ্ছ্বাসে ভিটেমাটি হারিয়েছে শিশু জিহানের পরিবার। ঘটনার সময় জিহানকে তার খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে তার বাবা-মা ছিল। কিন্তু কিছুই রক্ষা করতে পারেননি তারা। রাশেদ ও ওমর ফারুক ঘর থেকে বের না হলেও প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে এ ঘূর্ণিঝড়ে। তাদের ঘরেও পানি প্রবেশ করেছে। এমন ভয় তারা আর কখনো পায়নি।

কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমি কর্মস্থলে ছিলাম। নদী এলাকাও পরিদর্শন করেছি। গাছপালা ও ঘরবাড়ি ভেঙে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তীতে তালিকা করে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান খান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া তীররক্ষা বাঁধের চলমান প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রয়েছে। কাজ শেষ হলেই এই উপকূল সুরক্ষিত হয়ে উঠবে। ৯২টি প্যাকেজে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে। বছরে ৪ মাসের বেশি নদীতে কাজ করা সম্ভব হয় না। এর মধ্যে জোয়ারের কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে দিনে ৬-৭ ঘণ্টার বেশি কাজও করা যায় না। এখন জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। একইসঙ্গে ব্লক তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। আগামী বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজের মেয়াদ রয়েছে। জিও ব্যাগ স্থাপন ও ব্লক তৈরি শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জুন মাসে ‘লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার বড়খেরী ও লুধুয়াবাজার এবং কাদিরপন্ডিতেরহাট এলাকা ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দেয়। ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। একই বছরের আগস্ট মাসে প্রকল্পের টেন্ডার হয়। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে পুরো কাজ ৯৯ প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি কাজের উদ্বোধন করা হয়। এরপর বালু সংকট দেখিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু দিন কাজ বন্ধ রাখে। এখন কাজ চলমান রয়েছে।

হাসান মাহমুদ শাকিল/আরএআর