জীবিকার তাগিদে প্রায় দুই বছর আগে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট চরপাড়া গ্রামের সোহান প্রামানিক, সাগর হোসেন ও বিদ্যুৎ হোসেন পাড়ি জমান আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায়। একই গ্রামের নাজিম আলীও দুই মাস আগে লিবিয়াতে যান কাজের জন্য। সবই ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু গত ২ জুন লিবিয়া প্রবাসী এই চার যুবককে জিম্মি করে অমানুষিক নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে তাদের পরিবারের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে।

গত ছয় দিন ধরে মুক্তিপণের দাবিতে জিম্মি যুবকদের পরিবারের কাছে শারীরিক নির্যাতনের ভিডিও পাঠাচ্ছেন অপহরণকারীরা। এতে অপহৃতদের পরিবারে চলছে আহাজারি। দ্রুত চারজনকে মুক্ত করতে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।

অপহরণকারীদের পাঠানো ভিডিওতে দেখা যায়, লিবিয়া প্রবাসী সোহানকে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করছে অপহরণকারীরা। এরপর এক এক করে নাজিম, সাগর ও বিদ্যুৎকেও নির্যাতন করে সেই ভিডিও তাদের পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা করে মোট ৪০ লাখ টাকা দাবি করছেন অপহরণকারীরা। আর এতে আতঙ্কগ্রস্ত জিম্মি প্রবাসীদের স্বজনরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই বছরের বিভিন্ন সময় বিয়াঘাট চরপাড়া গ্রামের শাজাহান প্রামাণিকের ছেলে মো. সোহান প্রামাণিক (২৫), মো. তয়জাল শেখের ছেলে মো. সাগর হোসেন (২৪), মৃত শুকুর আলীর ছেলে নাজিম আলী (৩১) ও হামলাইকোল গ্রামের এনামুল হকের ছেলে মো. বিদ্যুৎ হোসেন (২৭) লিবিয়া যান। এদের মধ্যে বিদ্যুৎ হোসেনের বাবা এনামুল হক এখনও লিবিয়া আছেন।

লিবিয়ায় জিম্মিদশায় পড়া যুবক সোহানের বাবা শাহজাহান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত রোববার ইমু নম্বরে কল করে সোহান জানায় তাদেরকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণকারীরা বাংলায় কথা বলছে। ১০ লাখ টাকা না দিলে মেরে ফেলবে। ছেলেকে ঋণ করে বিদেশে পাঠিয়েছি। বাড়ির ভিটে ছাড়া কোনো জমাজমিও নেই। এত টাকা কোথায় পাব। এ অবস্থা থেকে ছেলেকে মুক্ত করতে তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

অপহরণের শিকার নাজিম আলী, সাগর হোসেন, সোহান প্রামাণিক ও বিদ্যুৎ হোসেন   

জিম্মি সাগরের বিধবা মা ছকেরা বেওয়া বলেন, আমি সরকারি টিআর কাবিখা প্রকল্পে কাজ করি। অনেক কষ্টে ঋণ করে সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়েছি। এখন আবার ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছেলেকে ছাড়াতে হবে। এত টাকা কোথায় পাব জানি না। আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই।

আজ শুক্রবার রাতে জিম্মি নাজিমের স্ত্রী নাদিরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপহরণকারীরা আমার স্বামীকে ছেড়ে দিতে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে। কিন্তু আমার এখন ১০ হাজার টাকা দেওয়ার মতোও সামর্থ্য নেই। কত কষ্ট করে ঋণ করে স্বামী বিদেশে গেছে। এখন মোবাইল ফোনে নির্যাতনের ভিডিও পাঠাচ্ছে অপহরণকারীরা। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। সন্ধ্যায় আমরা থানায় এসেছি। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম বলেন, অপহরণকারীরা বাংলায় কথা বলছে। তার মানে তারা বাংলাদেশি। অপহরণকারীরা বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা দাবি করেছে। তবে পরিবারগুলোর পক্ষে টাকা পরিশোধের সামর্থ্য না থাকায় তাদের জীবন এখন হুমকির মুখে। সরকার যেন দ্রুত উদ্ধারের পদক্ষেপ নেয় এই আহ্বান জানাই আমরা।

এ বিষয়ে নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যেহেতু পুরো ঘটনাটি লিবিয়ায় ঘটছে এবং এখন পর্যন্ত কোনো মোবাইল নম্বর কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর তারা দেয়নি তাই এখনো নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কোনো ব্যক্তি বা এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়নি। তাদের ধারণা, ওইখানে বাংলাদেশি কোনো মাফিয়া বা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েছে প্রবাসী চারজন।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, আমরা বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখছি, বাংলাদেশের কেউ জড়িত রয়েছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গোলাম রাব্বানী/এমজেইউ