ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ঢালচরের একমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক বিধ্বস্ত / ছবি : ঢাকা পোস্ট

‘তিন বছর আগের কথা। প্রসূতি মাকে নিয়ে ট্রলার ভাড়া করে চরফ্যাশনের হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় একটি পরিবার। কিন্তু কচ্ছপিয়া ঘাটেও পৌঁছাতে পারেনি। মাঝ নদীতে ট্রলারেই মারা যান অনাগত শিশু ও প্রসূতি মা। অত্যন্ত নির্মম এমন ঘটনার মুখোমুখি আমরা প্রায়ই হই। অনেকেই ডাক্তারের কাছে পৌঁছার আগেই আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন। আমাদের এখানে ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এভাবে আমাদের মৃত্যু হতো না। আফসোস, আমাদের করার কিছুই নেই।’

কথাগুলো বলছিলেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক আনিসুর রহমান। এই প্রতিবেদকও একই ট্রলারের যাত্রী। আনিসুর রহমানের সঙ্গে কচ্ছপিয়া ঘাটে পরিচয়। উপজেলা সদরে কাজ সেরে তিনি ফিরছিলেন বাড়িতে। 

আনিুসর রহমান বলেন, ‌‌ঢালচরে চিকিৎসা সেবার ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। এখানকার মানুষগুলো খুবই কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছে। নেই কোনো চিকিৎসক। অসুস্থ হলে কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা নেই।

মেঘনা পাড়ি দিয়ে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঢালচরের উত্তরে বিলীন হয়ে যাওয়া লঞ্চঘাটের ভগ্নাংশে কয়েকটি নারিকেল গাছের কেটে রাখা গোড়ায় রশি ছুড়ে ট্রলার আটকে নোঙর করা হয় ট্রলারটি। ট্রলারের সিঁড়ি প্রথমে নদীর তীরে পানির মধ্যেই দেওয়া হয়। সেই পানি-কাদা ডিঙিয়ে নারী, শিশু, বৃদ্ধ চরে উঠতে লাগলেন।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা বলেন শরীফুল ইসলাম নামে আরেক যাত্রী। মাঝবয়সী এই যুবক শারীরীক প্রতিবন্ধী। চলাচলে কিছুটা সমস্যা হলেও উত্তাল মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের মোহনা পাড়ি দিয়ে নিয়মিত চরফ্যাশনে যাতায়াত করার সক্ষমতা রয়েছে। সরকারি ব্রজমোহন কলেজ থেকে স্নাতোকত্তর শেষ করে যোগ দিয়েছেন কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে।  

শরীফুল বলেন, আগের বন্যায় কমিউনিটি ক্লিনিকটির সামান্য ক্ষতি হয়েছিল। রেমালে ক্লিনিক ভবনের নিচ থেকে মাটি নিয়ে যাওয়ায় ভবনটি খাদে উপুড় হয়ে পড়েছে। আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। তারপরও আশা ছিল সংস্কার করা যাবে। কিন্তু এখন আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। ক্লিনিক ফেলে দিয়েছে, আমার ঘরটিও জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কিছুই নেই আমার। এখানকার মানুষ পুরোপুরি স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। বছরের পর বছর ধরে এভাবে চলছে।

তিনি বলেন, অধিকাংশ মানুষ নদীতে কাজ করেন বলে তাদের এলার্জি, চর্মরোগের সংক্রমণ বেশি। এছাড়াও অন্যান্য বড় বড় রোগে ভুগতে হয়।

ট্রলার ঘাট থেকে হেঁটে আনন্দবাজারে ঢুকলেই চোখে পড়বে একতলা একটি ভবন ভাঙনের খাদে উপুড় হয়ে আছে। আনিসুর রহমান ও শরীফুল ইসলাম হাত তুলে দেখালেন, এটাই কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন।

পরদিন খুব ভোরে যখন রেমালে ক্ষতবিক্ষত ঢালচরে ঘরবাড়ি, সড়কের ভগ্নস্তূপ ডিঙিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি যান এই প্রতিবেদক, তখন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার কণ্ঠে একই আক্ষেপ- সব নিয়ে গেছে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী কোনো চিকিৎসাও পায়নি কেউ।

জরিনা বেগম নামে এক নারী পায়ের ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলেন, ‘প্রথম বাতাস যখন শুরু হইছে আচুক্কা একটা টিন আইয়্যা পড়ে মোর গোড়ালিতে। কাইট্টা গলগলাইয়্যা রক্ত বাইরাইতে থাহে। হেরপর যখন ঢেউ আইস্যা আমগো ঘরবাড়ি, আলমারি, থালাবাসন ভাসায়ে নিয়ে যাইতে লাগলো তহন চাইয়া চাইয়া দেখলাম। এক সময় মোরাও হগোলডি ভাইস্যা যাই। কোনো মতে হাতরাইয়্যা তীরে উঠতে পারলেও ঝড়ের পর পায়ের কাটা ঘা বাড়তে থাহে। আমাগো এ জায়গায়তো ডাক্তার নাই। কোনো ওষুধ খাইতে পারি নাই।’

নাজমা বেগম নামে আরেক গৃহিণী বলেন, ‘আমাগো চরে ডাক্তার নাই। ফার্মেসী দিয়া যা পারি হেইয়্যা আইন্যা খাই। শহরে (চরফ্যাশনে) কেউ থাকলে হ্যাগোরে মোবাইলে কতা কইয়্যা হুনি, বা হেরা রোগের ভাও (ধরণ) বুইঝ্যা ডাক্তারের ধারে কইয়্যা ওষুধ লেখায়। আমরা এইহানে নামে নাম মিলাইয়্যা কিন্না খাই। ডাক্তার কেমন হ্যায় জানি না।’

স্থানীয় বাসিন্দা ফখরুল মুন্সী বলেন, রোগ-শোক ঢালচরের নিত্যসঙ্গী। যত বড়ই রোগ হোক এখানে ডাক্তার নেই। আমরা প্রকৃতির প্রতিকূলতায় যেমন অসহায় তেমনি চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় আরও অসহায়। শিশু, কিশোর বয়স্করা জ্বরসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে ভোগান্তির অন্ত থাকে না। চরে সরকারি ক্লিনিক যা ছিল তা একে একে বিলীন হয়ে গেছে।

ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার শিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, এই চরে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক দুষ্কর। সকাল সাড়ে ৯টায় একটি বড় ট্রলার চরফ্যাশনের কচ্ছপিয়া ঘাটে যায় আবার বিকেল ৩টায় সেখান থেকে ফিরে আসে। এর বাইরে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন বা জরুরি কোন চিকিৎসার দরকার হয় তাহলেও এই দুই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

জেলে অধ্যুষিত এই এলাকায় তাই ৯০ শতাংশ মানুষ হাতুড়ে চিকিৎসার ওপর নির্ভর করেন। ওষুধ সর্ম্পকে মোটামুটি যে ধারণা আছে তা ব্যবহার করে যার যার মতো করেই ওষুধ কিনে তাৎক্ষণিক অসুস্থতা মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। এতে দেখা যায় উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। এজন্য আমাদের এখানে জরুরি ভিত্তিতে একজন চিকিৎসক দেওয়া হলে অন্তত হাতুড়ে চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করতে হতো না হতদরিদ্র এসব মানুষদের।

ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম হাওলাদার বলেন, চিকিৎসা সেবা বলতে শুধু একটা কমিউনিটি ক্লিনিক চালু ছিল। এবারের বন্যায় সেই ক্লিনিক ভবনটি ধসে পড়েছে। যেটুকু চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। সেগুলোর যদি ব্যবস্থা করা হয় তাহলে এখানকার অবহেলিত জনগণ কিছুটা হলেও চিকিৎসা সেবা পাবে।

ভোলার সিভিল সার্জন ডা. কে এম শফিকুজ্জামান বলেন, জেলার মধ্যে দুর্গম ৩৩টি স্থান রয়েছে যেখানে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় ঢালচরকে। এখানকার বাসিন্দাদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই আমাদের পক্ষ থেকে এগিয়ে না গেলে। সর্বশেষ একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। সেটিও ভাঙনে হেলে পড়েছে। যে কারণে চাইলেই চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। গুরুতর হলে নৌযান যোগে চরফ্যাশনে রোগী নিয়ে আসেন তারা।

তিনি বলেন, তবে বর্তমানে আমরা হাট ট্যুরিস্ট পদ্ধতিতে ওখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা করছি। অর্থাৎ আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে কয়েকদিন পর পর মেডিকেল টিম পাঠিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করি। ইপিআই কার্যক্রমে চিকিৎসা দিচ্ছি।

সিভিল সার্জন বলেন,  ঢালচরে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য গত দেড় মাস আগে আমরা প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। প্রস্তাবনাটি গ্রহণও হয়েছে। ক্লিনিকের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে যেখানে বন্যার পানি পৌঁছাবে না। আশা করছি আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে ভবন নির্মাণে কাজ শুরু করবে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

প্রসঙ্গত, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা সদর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে বড় ট্রলার যোগে আড়াই ঘণ্টা মেঘনা পারি দিয়ে দক্ষিণে পৌঁছলে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ষাটের দশকে জেগে ওঠা ঢালচর বর্তমানে একটি ইউনিয়ন পরিষদ। এখানে ১০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করেন। যাদের পেশা মৎস্য আহরণ। মূলত ইলিশ ধরার জন্য এই চর অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ঘূর্ণিঝড় রেমালে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে ঢালচরকে। চরের বাসিন্দারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

আরএআর