কবে আবার ক্লাসে ফিরতে পারবে জানে না ঢালচরের ১২শ শিক্ষার্থী
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ৮টা পার হয়েছে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সড়কে এসে দাঁড়ায় রেদোয়ান। মা-বাবা রেদোয়ানকে মাদরাসায় যাওয়ার জন্য আগের মতো তাড়া না দিলেও অভ্যাসগত কারণে হেঁটে মাদরাসায় যাচ্ছিল সে। রেদোয়ান বলে, ‘ম্যালা (অনেক) দিন মাদরাসায় যাইতে পারি নাই। মাদ্রাসায় যাই...’
বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে মাদরাসা প্রাঙ্গণে পৌঁছে রেদোয়ান দেখে তার প্রিয় মাদরাসাটাই নেই। কিছু চেয়ার, ভাঙা বেড়া, টিনের চালা, ভেজা বই, মানুষের কঙ্কাল এখানে সেখানে পড়ে আছে। আফসোস না বাড়িয়ে বাসায় ফিরতে পা বাড়ায় সে। ইতোমধ্যে হয়তো বাড়িতে পাশের প্রতিবেশী বন্ধুরা এসেছে খেলতে।
বিজ্ঞাপন
রেদোয়ান বলে, ‘আমাগোডাও পড়ছে, রামিমগোডাও পড়ছে। আমারও মাদরাসা বন্ধ, রামিমগোও স্কুল বন্ধ।’
প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রেদোয়ান জানে না ঠিক কবে আবার ক্লাসে ফিরতে পারবে। মূলত সে মাদরাসায় আসে বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, খেলাধুলা করবে এজন্য।
শুধু রেদোয়ান নয়, ঢালচরের কমপক্ষে ১২শ শিক্ষার্থী পড়ালেখা নিয়ে মারাত্মক অনিশ্চয়তায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। ভেসে গেছে বইয়ের ব্যাগ, ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে পাঠ্যবই। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় রেমাল পর্যটন আর ইলিশ আহরণে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই চরে তাণ্ডব চালিয়ে সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দেখা গেল, অবকাঠামো মেরামত বা দ্রুত সময়ে সংস্কার করার কোনো সুযোগ নেই।
ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এগুলো নতুন করে নির্মাণ করা ছাড়া মেরামতের সুযোগ নেই। ঢালচরের মোট জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ জেলে। তারা লেখাপড়া জানে না। মাত্র দুই শতাংশের অক্ষর জ্ঞান রয়েছে। এই অবস্থায় স্কুল-মাদরাসা দ্রুত চালু করা না গেলে শিক্ষার্থীদের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আর একটি দাখিল মাদরাসা রয়েছে এখানে। এর মধ্যে ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৪৫ জন, চরসত্যেন উত্তর ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫৩ জন, পশ্চিম ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০৭ জন শিক্ষার্থী। পশ্চিম ঢালচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০০ ও ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় ৪০০ জন মিলিয়ে সর্বমোট ১২০৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন ভেঙে যাওয়ায় এসব শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারছে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। অফিস কক্ষের সমস্ত বইপত্র ভিজে গেছে। ব্লাক ও হোয়াইট বোর্ড পড়ে আছে। চেয়ার-টেবিল নদী তীরে এখানে সেখানে পড়ে আছে। শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল করানোর জন্য রাখা মানবদেহের কঙ্কাল ভেঙে পড়েছে।
ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম কোস্ট ফাউন্ডেশনের নিচতলায় চললেও ঝড়ে তা গুড়িয়ে দিয়েছে। এখনো সেখানে পানি জমে আছে। যে কারণে বিদ্যালয়টির বেঞ্চ, চেয়ার পেছনের একটি বাড়ির আঙ্গিনায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
চরসত্যেন উত্তর ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিম ঢালচর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবনের টিনশেড ঘর দুটি কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থাকলেও এর টিনগুলো ভেঙে চুড়মার হয়ে গেছে। অফিস কক্ষের আসবাব, বই সব ভিজে গেছে। অনেক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্লাবনে ভেসে গেছে। এছাড়া পশ্চিম ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের বেড়া ভেঙেছে, ভিটের মাটি ভেঙে নিয়ে গেছে।
ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আকলিমা আক্তার বলেন, ‘বইন্যাতো চইল্যা গ্যাচে। আমাগো ইশকুলডা খুললে ভালো লাগতো। ইশকুল ভাইঙা গ্যাচে। আমাগো বেঞ্চ-চেহার (চেয়ার) আরেক বাড়ির উডানে নিয়া রাখচে।’
মাদরাসা শিক্ষার্থী ইয়াসমিন বলেন, আমাদের মাদরাসায় কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ক্লাস চালু করার মতো। সবকিছু ভেঙে ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কবে আবার মাদরাসা ঠিক করবে জানি না। কবে আবার ক্লাসে যেতে পারব তাও জানি না।
হাসান নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের স্কুলটি মেরামত করতে কম হলেও একমাস সময় লাগবে। এতদিন ক্লাস না করলে আমরা পিছিয়ে যাব। স্যাররা আমাদের বলেছেন বাসায় লেখাপড়া করতে। বাসায় যে পড়ব আমাদের বইতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জামাল উদ্দিন বেল্লাল বলেন, অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। ঢালচরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই যেখানে সহজেই ক্লাস চালু করা যাবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেঙে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। আমরা শিক্ষা অফিসকে জানিয়েছি। তারপরও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ডেকে নিয়ম রক্ষার স্বাক্ষর রেখেছি। এ ছাড়া আসলে আমাদের কিছুই করার নেই। না পারছি ওদের বসতে দিতে না পারছি অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে। ওদের বইখাতাওতো ভেসে গেছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি ঈদুল আজহার বন্ধ শেষ হওয়ার আগেই মোটামুটি একটা অবস্থানে নিতে।
ভোলা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ঢালচরে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে বরাদ্দ আসবে। বরাদ্দ পেলেই প্রতিষ্ঠানগুলো মেরামত করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে।
ভোলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আলমগীর হুসাইন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগেই আমরা ঝূঁকিপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অবহিত করেছি। ঘূর্ণিঝড়ের পরও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্ম্পকে তালিকা পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করে চালুর জন্য চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ মে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো ইউনিয়নটির দুই হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। সেখানকার রাস্তা ভেঙে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। প্রায় ৫ শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম হাওলাদার।
আরএআর