মরিচ আবাদে লাল সোনায় খ্যাত হয়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলা। চা শিল্পের পর পঞ্চগড় মরিচ উৎপাদনেও সমৃদ্ধ হচ্ছে দিন দিন। চলতি বছরে লাল মরিচ থেকে ১ হাজার ৫শ কোটি টাকা বাণিজ্য হবে বলে সম্ভাবনা দেখছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস। গত বছর ৭৫০ কোটি টাকার বাণিজ্যের কথা জানিয়েছিল এই কৃষি বিভাগ। 

এ বছর অনাবৃষ্টি ও তাপ প্রবাহের কারণে মরিচ আবাদে ফলন মোটামুটি হয়েছে। তবে যে আবাদ হয়েছে তাতে মরিচে উপযুক্ত দাম পেলে এ বছর মরিচ বাণিজ্যে রেকর্ড গড়ার সম্ভাবনা দেখছে পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার মরিচে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি। তাতে করে আমরা রেট গোল্ড গড়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। 

পঞ্চগড় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, জেলায় চলতি বছরে ৮ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদ হয়েছে। ২০২৩ সালে মরিচ আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ২৫ হেক্টর জমি। এবছর ৬৬২ হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদ বেশি হয়েছে। এ থেকে ১৭ হাজার ২৮০ মেট্রিক টন মরিচ উৎপাদন হবে। এতে মরিচের দাম ভালো হলে ১ হাজার ৫শ কোটি টাকা মরিচে বাণিজ্য হবে বলে জানাচ্ছেন তারা। এ বছর সাত জাতের মরিচ চাষ হয়েছে জেলায়। সব থেকে বেশি চাষ হচ্ছে হট মাস্টার, বালু ঝড়ি ও বিন্দু জাতের মরিচ। 

এছাড়া দেশীয় জাতসহ জিরা, মল্লিকা, বাঁশ গাইয়াসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের মরিচ ব্যাপক চাষ হয়েছে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচ হিসেবে যা বিক্রি হয় তার চেয়েও বেশি শুকিয়ে বিক্রি করা হয়। অনেকেই আবার মরিচ শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন, পরে ভালো দামের আশায়। এই মরিচ বর্ষাকাল পর্যন্ত তুলতে পারবেন কৃষকরা। চা শিল্পের পর মরিচ আবাদেও নিরব বিপ্লব ঘটছে এ জেলায়। 

জেলার তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, সদর ও আটোয়ারীর উপজেলার গড়িনাবাড়ি, আটোয়ারীর তোড়িয়া ও মির্জাপুরসহ বেশ কিছু এলাকাগুলোতে দেখা যায়, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে চাষিরা খেত থেকে তুলছেন টকটকে লাল মরিচ। ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। বাড়ির উঠান, রাস্তার, পুকুরপাড়, ফাঁকা মাঠ ও বাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় সেসব মরিচ শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। লাল মরিচের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে চারপাশ। চোখ যেদিকে যায় চোখে পড়ে লাল সোনার অপরূপ সৌন্দর্য।

স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা যায়, শুকনো মরিচ বাজারজাত ও বিভিন্ন বহুজাতিক কারখানায় সরবরাহ করার কাজে সরগরম হয়ে উঠেছে জেলার পাইকারি বাজারগুলো। ব্যবসায়ীরা জানান, পঞ্চগড়ের মরিচের আকার, বর্ণ ও স্বাদের কারণে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এসব মরিচ স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাজারগুলোতে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। শুকনো মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিনই এ এলাকার কাঁচা মরিচ ও শুকনো মরিচ কিনতে ছুটে আসছেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। জেলার শালবাহান, জগদল বাজার, ফুটকি বাড়ি বাজার, ঝলোই বাজার, ময়দান দিঘী বাজার ও টুনির হাটসহ বিভিন্ন হাট বাজার থেকে মরিচ কিনে নিয়ে যান তারা।

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১ বিঘা (৫০ শতক) জমিতে মরিচ উৎপাদনের ওপর খরচ হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। উৎপাদন হবে প্রায় ২০ মণ। বর্তমানে বাজারে শুকনো মরিচ বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে। এতে করে প্রতি মণ মরিচ বিক্রি ৮৪০০ টাকা হলে ২০ মণে ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বিক্রি করলে কৃষকের আয় হতে পারে ১ লাখ টাকা। 

আটোয়ারীর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের কৃষক আমিরুল ও সেলিম বলেন, দেড় বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। বিঘায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি ২০ মণ শুকনো মরিচ তুলব। 

তেঁতুলিয়ার শালবাহান এলাকার মরিচ চাষি রেজাউল জানান, এক বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। তবে এ বছর অনাবৃষ্টি ও তাপদাহের কারণে আবাদে ফলন কম হয়েছে। যা আবাদ হয়েছে বাজারে দাম পেলে আশা করছি কিছুটা হাতে আসবে।

জেলার অন্যতম বড় বাজার তেঁতুলিয়ার শালবাহান বাজার। মৌসুমে এ বাজারে প্রতি হাটে কোটি টাকার মরিচ বেচাকেনা হয়ে থাকে। এ হাটে মরিচ বিক্রি করতে আসা সোলায়মান ও জিয়ারুল জানান, হাটে এখন ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। চাষিদের ব্যবসায়ীদের প্রতি অভিযোগ করে বলছেন, এমনিতে তারা কম দামে কিনছে, তার মধ্যে প্রতি মণে ১ থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত শুকনো মরিচ অতিরিক্ত নিয়ে নিচ্ছে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোকামে চাহিদা কম থাকায় দাম কম যাচ্ছে। একই সঙ্গে মরিচের মান ও ওজনে কম হওয়ায় দাম কিছুটা কমেছে। তবে বাজার ভালো যাচ্ছে।

এদিকে কৃষকের খেতে মরিচ তুলে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন গ্রামীণ নারীরা। সংসারের কাজ সেরে এ সময়টাতে চাষিদের খেত থেকে মরিচ তুলতে ব্যস্ত তারা। এতে তারা সংসারে বাড়তি আয় করতে পারছেন বলে জানান নারী শ্রমিকরা। তারা জানান, প্রতি কেজি মরিচ তুলে তারা পান ১০-১২ টাকা। দিনে তারা মরিচ তুলে ৫শ থেকে ৭শ টাকা পাচ্ছেন। আবার কেউ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন। 

নারী শ্রমিক ফিরোজা আক্তার, আঞ্জুয়ারা ও মমতাজ বেগম বেগম বলেন, এ সময়টাতে মরিচ তুলে আমরা বেশ আয় করতে পারি। বছরে ১৫ থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত মরিচ তুলে আয় করতে পারি। এ টাকা দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়া ও হাত খরচ দিতে পারি। আর সংসারও  চলে যায়।

পঞ্চগড় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ মৌসুমে পঞ্চগড়ে ৮ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদ হয়েছে। ২০২৩ সালে মরিচ আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ২৫ হেক্টর জমি। এবছর ৬৬২ হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদ বেশি হয়েছে। এ থেকে ১৭ হাজার ২৮০ মেট্রিক টন মরিচ উৎপাদন হবে। এতে মরিচের দাম ভালো হলে ১ হাজার ৫শ কোটি টাকা মরিচে বাণিজ্য হবে। আমরা এবার মরিচ উৎপাদন ও দামে রেট গোল্ড হবে বলে মনে করছি। তবে এটা আরও বেশি হতো, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ফলন কিছুটা কম হয়েছে। তবে মরিচ বিক্রিসহ চাষিদের ভালো ফলন উৎপাদনে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

এসকে দোয়েল/আরকে