আম্পানে জোয়ারের পানিতে সব ভেসে যাওয়ার পর ক্ষতি পুষিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন চরসত্যেনের মাঝি জুলফিকার আলী। এরপর আসলো রেমাল। এবারের জলোচ্ছ্বাস তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। কীভাবে আবার এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠবেন তা জানা নেই জুলফিকারের।

ঢালচরের একটি অংশ চরসত্যেন। এই চরে বৃদ্ধ জুলফিকারের বাসা থেকে আনন্দবাজার পায়ে হাঁটা পথ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাজার বসে আর রাত ১১টায় জেনারেটর বন্ধ হলে ভেঙে যায়। বিমর্ষ জুলফিকার এই বাজারের এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে চোখের পানি ফেলছিলেন।

‌কান্নারত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘গেল বইন্যায়ও ঘরডায় মাডিচুটি গ্যাচিগ্যা, বেড়াগোড়া সব গ্যাচিগ্যা, উফরের চাল চাইরডা খাড়া আছিল। হেরপরে যহন ধুইল্যার (শুকনো) সিজন আইছে খুডিপালা লাগাইচি, টিন লাগাইচি। ঘর মেরামত করতে লাখ দেড়ের ট্যাকা গ্যাছে। ঘরে অনুমান আরও এক লাখ ট্যাকার মালামাল আছিল।’

‘এক বৎসরের খাটুনির কামাই দিয়া ঘর ঠিক করছিলাম রিমাল সব নিয়া গেল। খালি পোতাডা পইড়রা রইচে। আর তাউররা (তারুয়া সৈকত) দিয়া ছয়ডা গরু, আষ্টডা ছাগল আর হোলোডা (ষোল) হাস বানে ভাসাই নি গ্যাছে।’

জনাকীর্ণ বাজারে জুলফিকারের কান্নার দৃশ্যে অনেকের আগ্রহ নেই। কারণ বাজারে যারা ঘুরছেন তাদের অধিকাংশই জুলফিকারের মতই সর্বস্বান্ত। সবার হৃদয়েই একই রক্তক্ষরণ, একই হাহাকার। অধিকাংশরা বিভিন্ন দোকানে ঘুরছেন বাকিতে খাদ্যপণ্য কেনার জন্য।

ঢালচরের পূর্বপ্রান্তে রেমালের তাণ্ডব তুলনামূলক বেশি। পুরো চর ক্ষতবিক্ষত হলেও পূর্বপ্রান্তের মানুষজন অনেকেই ঘরের চালা খুঁজে ফিরছেন।

শনিবার (১ জুন) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আলো আঁধারির মধ্যেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাঠ সংগ্রহ করছেন রীনা বেগম। তার ভিটা মনিরের ভিটার দক্ষিণ পাশেই। এক সারিতে এভাবে সাতটি ভিটা পড়ে আছে।

সূর্য ওঠার আগেই কেন কাজে নেমে পড়লেন?- জানতে চাইলে রীনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, টেনশনে ঘুম আহে না। পোলাপান খাওন চায়। কি রানমু? চুলা নাই। রান্ধনের চাউল-ডাউল নাই। ঝড়ের পর দুই টিরিফে ছয় কেজির মতো চাউল পাইছি। যা পরিবারের মানসের দুই দিনও যায় না। আমার সংসারে লোক বেশি।

তিনি বলেন, ‘আমার দেড়-দুই লাখ টাকার ঘর। রইব্যার ১১টার দিকে বান আইলো আর ঘর-দুয়ার, মাটিচুডি সব ভাসাই নি গেল। কফালডা ভালো রেনডি (রেইনট্রি) গাছের উফরের ডালে দুইডা চাল আইটকা আছিল। এহন দুইখান চাল ছাড়া আমার কিচ্ছু নাই।’

কথা বলতে বলতে শিশু-ছেলে-বুড়ো মিলিয়ে ১৫/২০ জন জড়ো হয়ে যায়। যে যার মতো করে সেই ভোরেই বলতে শুরু করেন তাদের কষ্টের কথাগুলো। 

গৃহিনী শাহিনূর বেগম বলেন, ‘আমরা সমুদ্রের মোহনায় থাহি। দহিনে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে, পূবে আর পচ্চিমে বুড়া গৌরাঙ্গ, ম্যাঘনা। নদীর গর্জনে ঢালচরের কান্দন তরে গিয়া পৌঁছায় না। আমগো মেম্বার-চেয়ারম্যানগো গড়িমা বেশি। হেরা আমাগো খোঁজ ন্যায় না।  আমরা পান্তে (পানিতে) পইড়া ভাসি। মরি বা বাচি তাতে কার কি?’

তিনি আরও বলেন, ‘এই চরের অনেক পরিবারের ঘরে এক মুঠ চাউল নাই। পেন্দনে কাফুর নাই। আমরা খোলা আসমানের নিচে রাত কাডাই। আমরাতো ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারি না।’ 

ষাটোর্ধ্ব আব্দুল খালেক বলেন, কোম্মে যামু। যাওনের জাগা নাই। নদী মোগোরে সব নিয়া গ্যাছে, আবার নদীতে নামতে পারলে ধীরে ধীরে সবই জোগাইতে পারমু। আমাগো দুঃক্ক হোনার কেউ নাই, হেইজিন্য কারুর ধারে দুঃক্ক কইতে যাই না।

স্থানীয়রা জানান, ঢালচর, পূর্ব ঢালচর মিলিয়ে কমপক্ষে দুই হাজার মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। তাদের সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যকর টয়লেট এমনকি খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। দিন যত অতিবাহিত হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ততই হাহাকার বাড়ছে।

ঢালচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম পাটোয়ারি বলেন, ঢালচরে কমপক্ষে ৫শ ঘর নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সব তছনছ করে দিয়ে গেছে রেমাল। কয়েক হাজার গবাদি পশু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলো এখন খোলা আকাশের নিচে থাকছেন। সরকারি সহায়তা না পৌঁছানোয় ক্ষতিগ্রস্তরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম হাওলাদার বলেন, এখন পর্যন্ত যে সহায়তা এসেছে তা ব্যক্তি, স্বেচ্ছাসেবী ও উন্নয়ন সংস্থার। ত্রাণের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে যা পারছি সংগ্রহ করে দিচ্ছি। ঢালচরের মানুষেরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ৪/৫শ পরিবার ঘর হারিয়ে উন্মুক্ত স্থানে, স্বজন বা পরিচিতের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। খাবার, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা দ্রুত না করা হলে ঢালচরে মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে।

চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নওরীন হক বলেন, আমাদের ত্রাণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। ঢালচরের চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষতিগ্রস্থের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তালিকা পেলেই সহায়তা পৌঁছে যাবে।

প্রসঙ্গত, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা সদর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণের কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার নৌপথ পূর্ব ঢালচর। এছাড়া চরনিজাম, বয়ারচর মূল ঢালচর থেকে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার নৌপথ। প্রতিটি চরই বুড়া গৌরাঙ্গ, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত। এজন্য সব সময়ই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হন চরগুলোর বাসিন্দারা। এসব চরের দক্ষিণের আর কোনো চরে জনবসতি নেই।

আরকে