ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন বরগুনার মাঝেরচরের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী মিনারা বেগম। প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবে স্বজন হারিয়েছেন তিনি। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ই তার বাড়িঘর ও ফসলের মাঠ নষ্ট হয়ে ঘরের মালামাল ভাসিয়ে নিয়েছে। 

সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মিনারা বেগম ঢাকা পোস্টকে দুঃখ করে বলেন, আল্লাহ তুমি আমাগো লইয়া যাও। কতকাল আর আল্লায় পানিতে ভাসাইবে, কইতে পারি না।

বারবার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মিনারা আরও বলেন, সিডরের সময় ছেলে-মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে ঘরেই ছিলাম। যখন পানি ওঠা শুরু হয়েছিল তখন আমরা আশ্রয়ণে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। তবে পানির প্রচণ্ড স্রোতে আমাদের একেক জনকে একেকদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ওই সময়ে আমার এক নাতি মারা যায়। মাঝেরচর ছাড়া আমাদের আর থাকার কোনো জায়গা নেই। বিভিন্ন সময়ে বন্যায় আমাদের ক্ষতি হলেও বাধ্য হয়ে আমাদের এই চরেই থাকতে হয়।

এবার আবারও ঘূর্ণিঝড় রেমালে বেড়িবাঁধ ভেঙে পনিতে আমাদের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঘরের মালামাল। তিনদিন ধরে চলতে থাকা ঘূর্ণিঝড়ে আমরা অনেক কষ্ট করেছি। রান্না করে খাওয়ারমতো কিছুই ছিল না। প্রায় তিন চারদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। এছাড়া যে সময় থেকে মাঝেরচরে বসবাস শুরু করেছে সেই থেকেই আমরা বিভিন্ন সময় পনিতে ভেসেছি। ঘূর্ণিঝড় মেরালে যখন ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়েছে তখন মনের কষ্টে বলেছি, আল্লাহ তুমি আমাগো লইয়া যাও। পানিতে আর কত কাল ভাসতে হবে? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমাদের দেখার কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে বসবাস করতে উঁচু বেড়িবাঁধ প্রয়োজন। চরে ব্লক দিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরি করলে প্রতিবছর আর সংস্কার করার প্রয়োজন হয় না। আমরাও নিরাপদ থাকতে পারব।

বরগুনার বিষখালী নদীর মাঝে জেগে ওঠা মাঝেরচরটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বসবাস করছেন মিনারার মতো আরও অসংখ্য পরিবার। জীবনের নিশ্চয়তা না থকলেও থাকার জন্য বিকল্প কোনো জায়গা নেই তাদের। এতে বাধ্য হয়ে ওই চরেই বসবাস করছেন পরিবারগুলো। প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে মাঝেরচরে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ও ঘরবাড়ি সস্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসেই বাঁধ ভেঙে পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ে এ চরের বাসিন্দারা। সর্বশেষ আবারও ঘূর্ণিঝড় রেমালের ঝড়ো হাওয়ায় ও পানিতে প্লাবিত হয়ে ঘরবাড়ি বিধ্বস্তসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মাঝেরচরের বাসিন্দাদের। 

সরেজমিনে, মাঝেরচর নামক এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, রেমালের প্রভাবে জোয়ারের পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের মাঠসহ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের বসতঘর। এছাড়া ঝড়ো হাওয়ায় সস্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে অনেকের ঘরবাড়ি। 

মাঝেরচরের একজন বাসিন্দা মনোয়ারা বেগমের ঘর বিধ্বস্ত হয়ে সব মালামাল ভেসে গেছে পানিতে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কিছুই নেই সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ছেলেও বাড়িতে নেই, এখন ছেলের বউ আর নাতি নিয়ে আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। এছাড়া ছেলেরও তেমন সমর্থ নেই যে নতুন করে ঘর তৈরি করবে। আমাদের চরের চারপাশে নদী থাকায় আমরা বিপদে পড়লে কেউ দ্রুত এসে আমাদেরকে সহয়তাও করতে পারে না। 

কাঞ্চন আলী খান নামের ক্ষতিগ্রস্ত আরেক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিডরে সময় আমার ঘর থেকে তিনজন মারা গেছে। এরপর আবারও সবকিছু জোগাড় করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। তবে এবারের বন্যায় আবারও সবকিছু নিয়ে গেছে। এখন থাকার কোনো ঘর নেই আশ্রয়ণে আশ্রয় নিয়েছি। এভাবে দিনদিন ঘূর্ণিঝড়ে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিভাবে এখানে বসবাস করব। আমদের যদি টেকসই একটা বেড়িবাঁধ তৈরি করে দেওয়া হয় তাহলে কোনোভাবে ঘর তৈরি করে নিরাপদে থাকতে পারি।

বরগুনার মাঝেরচর নামক এ চরটিতে ২০০৫ সাল থেকে মানুষের বসবাস শুরু হয়। প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে এ চরের অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আবারও ঘরবাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন মাঝের চরের বাসিন্দারা। তবে প্রতিবারই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বরগুনায় মাঝেরচরের বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বরগুনা জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম বলেন, যে সমস্ত জায়গায় পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়েছে এর মধ্যে কিছু জায়গায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। আবার কিছু কিছু জায়গার বাঁধ ভেঙে ও উপচে পড়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। যে সমস্ত এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে সেখানে ইতোমধ্যে মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড মেরামতের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া আমরা চেষ্টা করছি যাদের ঘরে খাবার নেই, ঘর ভেঙে গেছে তাদেরকে দ্রুত প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার।

আব্দুল আলীম/আরকে