অযত্নে-অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর হাবাসপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পটির বেহাল দশা। ভূমিহীনদের স্বপ্নের ঠিকানায় তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। মরিচা ধরে টিনের ছাউনি ও দেয়াল ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। টিউবওয়েল ও শৌচাগারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। আবাসন প্রকল্পের ১২০টি ঘরের মধ্যে ৭০টি ঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাকিগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পরিত্যক্ত ঘরে গরু-ছাগল লালনপালন করা হচ্ছে। বেহাল দশার কারণে ৮০টি পরিবার আবাসন ছেড়ে চলে গেছে। তারপরও জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভূমিহীন ৪০ হতদরিদ্র পরিবার। 

এদিকে উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের হাবাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র তিনজন। এদের পড়ানোর জন্য শিক্ষক রয়েছেন চারজন। প্রতিদিন একজন বা দুইজন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। চার শিক্ষকের মধ্যে তিনজনই বেশিরভাগ সময় অনুপস্থিত থাকেন। 

এই সরকারি আবাসন প্রকল্প ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেহাল দশা নিয়ে গত ১৪ মে 'জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছে ৪০ পরিবার, পরিত্যক্ত পড়ে আছে ৭০টি' এবং গত ১৮ মে 'শিক্ষার্থী ৩ জন শিক্ষক ৪ জন, একটি সরকারি বিদ্যালয়ের গল্প' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয় ঢাকা পোস্টে। 

সংবাদ দুটি প্রকাশ হওয়ার পর বুধবার (২৯ মে) দুপুরের দিকে কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রউফ আবাসন প্রকল্প ও স্কুলটি পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে আবাসনের ঘর ও সড়ক মেরামত এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি করার আশ্বাস প্রদান করেন তিনি।

এসময় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আমিরুল আরাফাত, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। 

জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিদ্যালয়টির খোঁজ খবর রাখতে না পেরে দুঃখ প্রকাশ ও ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন সংসদ সদস্য রউফ। তিনি জানান, আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে আবাসনের ঘর ও একমাত্র সড়কটি সংস্কার করা হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

স্কুলের সহকারী শিক্ষক সাদিয়া আক্তার জানান, এমপি স্যার এসে স্কুল ও আবাসন প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন। আবাসনের ঘর ও সড়ক সংস্কারের কথা জানিয়েছেন। তা শুনে আমাদের মাঝে আশার আলো জ্বলেছে। আমরা সংস্কার কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।

এ বিষয়ে হাবাসপুর আবাসনের সভাপতি আজাদ শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এই আবাসনে ১৯ বছর ধরে বসবাস করছি। অযত্নে অবহেলায় ও সংস্কারের অভাবে আবাসনের ঘরগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা। টিউবওয়েল, বাথরুম, যাতায়াতের রাস্তা ও ঘরের খুবই সমস্যা। এগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ঘরের টিন পচে গেছে, ভেঙে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে এখান থেকে অনেক মানুষ চলে গেছে। ১২০ পরিবারের মধ্যে এখন ৪০ পরিবার এখানে বসবাস করে। বাকি ৮০ পরিবার চলে গেছে। তারা কুষ্টিয়া শহরে ভাড়া বাসায় থাকে, ভ্যান-রিকশা চালায়, কেউ কেউ দিনমজুর। তাদের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও চলে যাচ্ছে। এজন্য স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এখন মাত্র তিনজন ছাত্র। শিক্ষক রয়েছে চারজন। ছাত্র না থাকায় শিক্ষকরা গুরুত্ব দেয় না। স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। এসব সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন এমপি স্যার। 

এ বিষয়ে হাবাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোখসানা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০১৮ সালে এই স্কুলে যোগদান করি। তখন ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতেই আছে। এখন ৩ জন ছাত্র আছে। আমিসহ মোট চারজন শিক্ষক এই স্কুলে দায়িত্ব পালন করছি। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা ও আবাসন প্রকল্পের ঘরের বেহাল দশার কারণে বসবাসকারীরা আবাসন ছেড়ে চলে গেছে। এ কারণে শিক্ষার্থী কমে গেছে। 

প্রসঙ্গত, দুস্থ ও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য প্রায় ২০ বছর আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের হাবাসপুর গ্রামের পাশে গড়াই নদীর পাড়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। সরকারের খাস জমির ওপর টিনের দেয়াল ও ছাউনি দিয়ে নির্মিত আবাসন প্রকল্পের এক একটি ব্যারাকে ১০টি করে কক্ষ নির্মাণ করা হয়। ১২০টি ভূমিহীন পরিবারের জন্য ১২টি ব্যারাক (১২০টি ঘর) নির্মাণ করে দেয় সরকার। প্রতিটি পরিবারকে একটি করে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তবে অযত্নে-অবহেলা, সংস্কার আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আবাসন প্রকল্পটির এখন বেহাল দশা। পরিত্যক্ত ঘরে গরু-ছাগল রেখে লালনপালন করা হচ্ছে। প্রকল্পের প্রবেশমুখে রাস্তাটিরও বেহাল দশা। পরিত্যক্ত ঘরগুলো আগাছায় ছেয়ে গেছে। বেহালদশার কারণে ৮০ পরিবার আবাসন ছেড়ে চলে গেছে। তারপরও জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভূমিহীন ৪০ হতদরিদ্র পরিবার। ভূমিহীনদের স্বপ্নের ঠিকানায় তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। দ্রুত সংস্কার করে আবাসনটি টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন প্রকল্পে আশ্রিতরা।

২০১৩-১৪ সালে ‘১৫০ বিদ্যালয়’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ২০ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে এলজিইডি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৪ সাল থেকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে বিদ্যালয়টি। শুরুর দিকে অনেক শিক্ষার্থী থাকলেও বর্তমানে প্রায় শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়েছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন ৪ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে একজন বা দুইজন।

রাজু আহমেদ/এমএএস