এমপি আনার হত্যা
শাহীনের আলিশান বাংলোয় যা দেখা গেল
৪০ বিঘা জমির চারপাশ ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া, ভেতরে আলিশান বাংলো। বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকার একটামাত্র পথ। সেই পথের পাশে আম গাছের সঙ্গে বাঁধা আছে তিনটি বিদেশি (জার্মান শেফার্ড) কুকুর। অপরিচিত কেউ ভেতরে ঢুকলেই কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভেতরের আলিশান বাংলোতে আছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, ব্যায়ামাগার, সুইমিং পুল, গলফ খেলার মাঠসহ বিলাসবহুল জীবনযাপনের সব আয়োজন।
বিলাসবহুল এই বাংলোর মালিক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার নাম উঠে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২৬ মে) ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামে আক্তারুজ্জামান শাহীনের বাংলোতে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া। ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পথ, সেই পথের দুই পাশে আম ও বিভিন্ন ফুলের গাছ। পরপর তিনটি আম গাছে বাঁধা রয়েছে তিনটি বিদেশি কুকুর। একটু এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে গলফ খেলার মাঠ। পাশেই রয়েছে সুমিংপুল ও বিশ্রামাগার।
পাশের একটি ভবনের নিচ তলায় রয়েছে ব্যায়ামাগার ও খাবারের জায়গা। ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। দুটি ভবনেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) রয়েছে বেশ কয়েকটি। কর্মচারীদের থাকার জন্য রয়েছে আলাদা কোয়ার্টার। বারবিকিউ পার্টির জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। বাড়ির নিরাপত্তায় রয়েছে শতাধিক সিসি ক্যামেরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের আসাদুজ্জামান কাটুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ আক্তারুজ্জামান শাহীন। ১৯৮৫ সালে কোটচাঁদপুর পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কোটচাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৮৭ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এক বছর বিরতি দিয়ে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে দুই বছরের কোর্স করেন। সেখান থেকে জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।
চাকরির দুই বছর পর সিঙ্গাপুর থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন শাহীন। এরপর ফ্রি ভিসা পেয়ে ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে যান। পরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
জাহাজে চাকরি করার সময় ঢাকায় বিয়ে করেন শাহীন। তার স্ত্রীর নাম কনক ইসলাম। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তারা মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
২০১৭ সালে দেশে এসে এলাঙ্গী মাঠে বাংলো বাড়ির ওই জায়গায় প্রথমে ইটভাটা স্থাপন করেন শাহীন। লোকসান হওয়ায় তিন বছর পর ওই ভাটা বন্ধ করে দেন।
২০২১ সালে দেশে এসে ৪০ বিঘা জমির ওপর বাংলো বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনি। ২০২২ সালের শেষের দিকে বাংলো বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ২০২৩ সালে ওই বাড়ির উদ্বোধন করেন শাহীন। এর পর থেকে সেখানে নামিদামি ব্যক্তিদের আসা যাওয়া শুরু হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই বাড়িতে অনেক বড় বড় অফিসার আসতেন। তাদের পাহারা দিতে অনেক পুলিশ সদস্যও আসত। এমপি আনারও এই বাগান বাড়িতে আসতেন। ভেতরে তারা কী করতেন তা বাইরে থেকে বোঝা যেত না।
এলাঙ্গী গ্রামের কালু খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলোর পাশের জমিটা আমার। আগে সেখানে ইটভাটা ছিল। দুই বছর হলো এই বাড়িটি করা হয়েছে। তারপর থেকে শাহীন এখানে মাঝে মধ্যে আসেন। গ্রামের বা আশপাশের মানুষের সঙ্গে তিনি কখনো খারাপ ব্যবহার করেননি। উল্টো গ্রামের কেউ বিপদে পড়লে তাকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন।
বাংলোর দারোয়ান আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে কারা আসা যাওয়া করে সেটা আমি বলতে পারব না। দিনের বেলায় তেমন কেউ আসেন না। যখন আসে অনেক গাড়ি একসাথে আসে। আমি কাউকে চিনি না। আমি গেট পাহারা দিই, কুকুরগুলোকে খেতে দিই এবং আশপাশে খেয়াল রাখি।
এলাঙ্গী গ্রামের সাইদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শাহীনকে খুব কমই দেখেছি। এখানে বাংলো বাড়ি করার পর গাড়িতে করে মাঝে মধ্যে এখানে আসেন তিনি। বড় বড় দামি গাড়ি আসতে দেখেছি। সত্যি বলতে খারাপ কিছু দেখিনি। তবে এখন যেটা শুনছি সেটা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।
এলাঙ্গী ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. আমিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাহীনরা অনেক আগে থেকে বড়লোক মানুষ। শাহীনের বাবার অনেক জায়গা-জমি ছিল। শাহীন অনেক দিন আমেরিকায় থাকেন। বাংলো বাড়ি করার পর মাঝে মধ্যে আসতে দেখেছি। তবে ওই বাগান বাড়িতে রাতে কী হতো না হতো আমরা কিছু জানি না। গ্রামের কেউ ওই বাগান বাড়িতে ঢুকতে পারে না।
আক্তারুজ্জামান শাহীনের বড় ভাই ও কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহীদুজ্জামান সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাহীন আমার ভাই এটা ঠিক। কিন্তু অনেক আগে থেকেই সে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করত না। শাহীন যদি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকে, তদন্তে যদি আমার ভাই দোষী হয় বা অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে।
তিনি বলেন, শাহীন দেশে খুব কম আসত। আসলেও ঢাকায় তার ভাড়া বাড়িতে থাকত। পারিবারিক জমিতে আমার বাবা আমবাগান করেছিলেন, সেই আমবাগান ধ্বংস করে সে ইটভাটা করে। তিন বছর পর সেখানে বাড়ি করে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই। বাড়ি করার পর আমিও ওখানে কয়েকবার গিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে ডরিন খুবই ছোট মানুষ। তার বাবা মারা গেছে, সে কারণে তার অনেক কষ্ট। আমার বাবা হারালে আমিও ডরিনের চেয়ে বেশি কিছু বলতাম। গোয়েন্দা সংস্থার হাতে মামলাটি আছে। তদন্তে বেরিয়ে আসবে কে জড়িত। ডরিন বললেই পুলিশ আমাকে আটক করবে বিষয়টি এমন নয়। তারা তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যদি মনে করে আমাকে আটক করা দরকার, করবে। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। ১৬ মে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। ২২ মে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে খবর শোনা যায়। এখন পর্যন্ত তার মরদেহ উদ্ধার করতে পারেনি ভারতীয় পুলিশ।
আরএআর/জেএস