প্লাস্টিকের পরিবর্তে চাহিদা বাড়ছে সুপারি গাছের খোলের তৈজসপত্রের
এক সময় সুপারি বাগানে খোল পড়ে পচে যেত। এখন সেই পড়ে থাকা সুপারি গাছের খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে থালা, বাটি, ট্রে ও নাস্তার প্লেটসহ আকর্ষনীয় ডিজাইনের পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র। এতে করে পরিবেশ ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্য থেকে রক্ষা পাচ্ছে। বাজারে বিদ্যমান প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম বা একবার ব্যবহার উপযোগী প্লেটের বিকল্প হিসেবে পঞ্চগড়ে চাহিদা বাড়ছে সুপারি গাছের খোল দিয়ে তৈরি প্লেট, গ্লাস, বাটি।
জেলার বোদা উপজেলার শিমুলতলীতে ইকো বিডি গ্রিন নামের কারখানা গড়ে তুলেছেন নুরুল আলম সেলিম নামের এক উদ্যোক্তা। তার কারখানায় এখন সুপারি খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ওয়ানটাইম তৈজসপত্র।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, কারখানাটির মালিক নুরুল আলম সেলিম কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে শিমুলতলীতে গড়ে তোলেন সুপারি খোলের তৈজসপত্র তৈরির ইকো বিডি গ্রিন নামের কারখানাটি। কারখানা দেওয়ার পর থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপারি চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে সুপারি খোল। গ্রামীণ জনপদে পড়ে থাকা সুপারি গাছের খোল দিয়ে বাড়ির উঠোনে শিশুদের খেলার উপকরণ ও গৃহিনীদের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হলেও সে সুপারি খোল এখন বাহারি তৈজসপত্র তৈরির কাঁচামাল হয়ে উঠেছে। এ থেকে উৎপাদিত তৈজসপত্র বিক্রি হচ্ছে দেশ-বিদেশে।
বুধবার (১৫ মে) দুপুরে কারখানা ঘুরে দেখা যায়, জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা সুপারি গাছের পাতা কারখানায় স্তুপ করে রাখা। সুপারি পাতার নিচের অংশটি কেটে ফেলা হচ্ছে। এবার বাকিটুকু পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পরে রোদে শুকানো হয়ে গেলে খোলগুলো মেশিনে নেওয়া হয়। পাতার খোল ছাঁচের মেশিনে বসিয়ে তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে নানা আকৃতি দেওয়া হয়। এখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে গোলাকার বাটি, গোলাকার প্লেট, চৌকোনা প্লেট, লাভ প্লেট, চামুচ, ট্রেসহ ৮ ধরনের জিনিস তৈরি হয়। কারখানায় দৈনিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ পিস প্লেট-বাটিসহ ৮ ধরনের তৈজসপত্র উৎপাদন হয়। প্রতি পিস প্লেট, বাটি বিক্রি করা হয় ৭-১৫ টাকায়। কারখানা ঘিরে কর্মসংস্থান হয়ে বেশ কয়েকজন বেকার নারী-পুরুষের। খুঁজে পেয়েছেন আয়ের পথ। নারীরা এ আয় দিয়ে তাদের সংসারে স্বামী ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছেন।
কারখানাটির কর্মচারী সোহেল রানা কাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কারখানার মালিক ঢাকা থাকেন। বাড়ির পাশে কারখানা হওয়াতে এখানে চাকরি করতেছি। ভালোভাবে চলতেছি। কারখানাটি অনেক ভালো। আমার মতো অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ কারখানায় ১৫ জন কর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে সুপারি খোল বিক্রির জন্য উদ্বুদ্ধ করেন মানুষদের। সুপারি চাষিদের কাছ থেকে ঝরে যাওয়া প্রতিটি সুপারি খোল কেনা হয় ২-৩ টাকার মধ্যে। অনেকে এখন খোল বিক্রি করতে কারখানায় ছুটে আসেন। এতে করে সুপারি খোল বিক্রি করে গ্রামের নারীরাও টাকা আয় করতে পারছেন।
কারখানায় কাজ পেয়েছেন বেলি আক্তার ও কুলসুম বেগম নামের কয়েকজন নারী। তাদের মধ্যে কুলসুম ও বেলি বলেন, কারখানা হওয়ায় আমরা এখানে কাজ পেয়েছি। সারাদিন কাজ করি। এখান থেকে যা রোজগার হচ্ছে তা দিয়ে সংসারে সাপোর্ট দিতে পারছি।
কারখানা দেখতে আসা জামিরুল ইসলাম নামের এক ভ্যানচালক বলেন, সুপারি খোল দিয়ে থালা, বাটি তৈরি করা যায় তা জানতাম না। এখানে এসে দেখে অবাক হলাম। আমাদের বাড়িতে তো সুপারি গাছ আছে। অনেক সুপারি খোল পড়ে পচে যায়। এখন থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে এখানে এনে বিক্রি করার কথা ভাবছি।
কারখানার পরিচালক ফরিদুল আলম হিরু বলেন, আমরা পরিবেশ বান্ধব সুপারি খোল দিয়ে থালা, বাটি, ট্রেসহ ৮ ধরনের জিনিস বানাচ্ছি। এটা অনেক মজবুত। বাজারের যেসব প্লাস্টিকের প্লেট এনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়ে থাকে সেগুলো দেখা যায় খুব দুর্বল। একবার হাতে নিলেই ফেটে যায়। আমাদেরটা দু’তিনবার ব্যবহার করলেও সহজে ভাংবে না। দেখতেও সুন্দর ও সহজে পরিবহনযোগ্য। এটি ব্যবহারের পর মাটিতে ফেলে দিলেও পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না। এটি পঁচে জৈব সার হয়ে যাবে।
ঢাকা থেকে মুঠোফোনে কারখানাটির মালিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তো পঞ্চগড়ে সুপারি, চা, আমসহ বিভিন্ন কৃষি আবাদ করছি। হঠাৎ করে চিন্তা হলো এ ধরনের কারখানা এলাকায় গড়া যায় কিনা। সে চিন্তা থেকেই বোদার শিমুলতলীতে কারখানাটি দেয়া। বিশেষ করে বাজারে যেসব ওয়ানটাইমের প্লাস্টিকের তৈরি থালা ব্যবহার করা হয় তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর সুপারি খোলে তৈরি থালা পরিবেশে কোন ক্ষতি করে না। এটা দিয়ে দু’-তিনবার ব্যবহার করা যায়। হাতে নিয়েও খাওয়া যায়। এটি পরিবেশবান্ধব। তাই আমরা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি এটা পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। এ জন্য আমরা এ বাটিগুলো তৈরি করছি। সুপারি বাগানের মালিকদের উদ্বুদ্ধ করছি, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝাচ্ছি। এদের কাছ থেকে আমরা সুপারি খোল সংগ্রহ করছি। এতে করে সুপারি মালিকরাও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আর এ কারখানা ঘিরে অনেক বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিক বর্জন করে পরিবেশ সুরক্ষায় আরো কারখানা গড়ে তোলা দরকার। এ কাজে বেকার যুবকরা এগিয়ে এলে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো রকম রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই ঝরে পড়া সুপারির খোল থেকে এসব তৈজসপত্র তৈরি করে তা দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। এক সময় প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে মানুষ এই পণ্য ব্যাপকহারে ব্যবহার করবে ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
বোদা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার নজির বলেন, বোদা উপজেলার শিমুলতলীতে সুপারি খোল দিয়ে পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র তৈরি ভালো একটি উদ্যোগ। এটি যেমন স্থানীয়ভাবে বেকারদের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। পাশাপাশি সুপারির খোলে তৈরি তৈজসপত্রের দেশ-বিদেশেও এর চাহিদা রয়েছে। এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। তাই এ ধরনের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানাই।
এসকে দোয়েল/আরকে