সাপ উদ্ধার শেষে সাপের খেলা দেখাচ্ছেন সাপুড়ে মিনু ঢালী / ছবি : ঢাকা পোস্ট

চরাঞ্চলে বেড়েছে সাপের উপদ্রব। বাসা বাড়ি, ফসলি জমিসহ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে রাসেলস ভাইপারসহ বিষধর সব সাপ। গত এক মাসেরও কম সময়ে সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে পাঁচ জনের। সাপের এমন উপদ্রবে চরাঞ্চলের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

প্রতিদিন একাধিক সাপ উদ্ধার করে চরের বাসিন্দাদের অনেকটা আতঙ্কমুক্ত করেছেন সাপুড়ে মিনু ঢালী (৫৫)। এক জীবনে তিনি দশ হাজারের অধিক সাপ উদ্ধার করেছেন। তার উদ্ধারকৃত ভয়ংকর রাসেলস ভাইপার প্রজাতির একটি সাপ এর আগে নেওয়া হয়েছিল ভেনম রিসার্চ সেন্টারে। পেশায় একজন কৃষক হলেও মিনু ঢালী গত এক মাস ধরে প্রায় প্রতিদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন সাপ উদ্ধার কাজে।

সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার ডিমএম খালী ইউনিয়নের কাজী কান্দি গ্রামের বাসিন্দা সাপুড়ে মিনু ঢালীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কাজী কান্দি গ্রামের আলী হোসেন ঢালীর ছোট ছেলে মিনু ঢালী পেশায় একজন কৃষক। প্রায় ৩৬ বছর আগে স্বপ্নযোগে সাপ ধরার কৌশল শিখেছেন তিনি। এরপর থেকে কোথাও সাপ দেখা গেলে মিনু ঢালীকে খবর দেওয়া হয়। মিনু ঢালীও সুনিপুণভাবে সাপ উদ্ধার করে আতঙ্কমুক্ত করেন মানুষকে। একই সঙ্গে তিনি সাপের খেলা দেখিয়ে ছেলে-বুড়ো সবাইকে আনন্দ দিয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সাপ উদ্ধার করতে গিয়ে মিনু ঢালী একাধিকবার বিষধর কোবরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপের ছোবলও খেয়েছেন।

মিনু ঢালী / ছবি : ঢাকা পোস্ট

সম্প্রতি পদ্মা মেঘনা বেষ্টিত শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জসহ সখিপুর থানার বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়েছে রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপের উপদ্রব। সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় সাত সদস্যের একটি মেডিকেল টিম গঠন করেছে ভেদরগঞ্চ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সখিপুরের চরভাগা, কাঁচিকাটা, চরসেনসাস, উত্তর ও দক্ষিণ তারাবুনিয়া, ডাক বাংলা রোড, ছৈয়াল কান্দি, ঢালী কান্দিসহ প্রায় সব এলাকার বাসা বাড়িসহ ফসলি জমিতে দেখা মিলছে ডিমসহ বিষধর গোখরা, জাতি সাপ, দাঁড়াশ, রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপের উপদ্রব। সাপের উপদ্রব এমন বেড়ে যাওয়ায় একই সময়ে একাধিক স্থান থেকে সাপ উদ্ধার করার খবর আসে মিনু ঢালীর কাছে। এমন সমস্যা সমাধান করতে তিনি সখিপুর ইউনিয়নের মল্লিক কান্দি গ্রামের বারেক মামুদ নামে একজনকে সাপ ধরার কৌশল শিখিয়েছেন। এখন মিনু ঢালী ও বারেক মামুদের ব্যস্ত সময় কাটছে বিষধর সব সাপ উদ্ধার করতে। এসব সাপের কাপড়ে গত এক মাসেরও কম সময়ে সখিপুরসহ জেলার অন্যান্য উপজেলায় কমপক্ষে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার (১৮ মে) দুপুরে দক্ষিণ তারাবুনিয়ার শাহ আলম শেখের বাড়ি থেকে বিশালাকৃতির দুইটি রাসেলস ভাইপারসহ গত এক মাসে বিভিন্ন প্রজাতির শতাধিক বিষধর সাপ ডিমসহ উদ্ধার করেছেন সাপুড়ে মিনু ঢালী। সাপগুলো উদ্ধার করার সময় কিছু সাপ মারা গেলেও অধিকাংশ সাপই তিনি সাপ খেলা দেখানো সাপুড়েদেরকে দিয়ে দেন। মিনু ঢালীর সুনাম বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ার পরে চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্চ সেন্টার থেকে এক গবেষক এসে তার উদ্ধারকৃত একটি রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে গেছেন এন্টি ভেনম তৈরির কাজ করতে।

সাপুড়ে মিনু ঢালী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ৩৬ বছর আগে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নযোগে সাপ উদ্ধার করার কৌশল শিখেছি। কৃষকের সন্তান হওয়ায় প্রথমে বিষয়টি কেউ বিশ্বাস করতে চাইত না। পরে যখন ধীরে ধীরে সাপ উদ্ধার করে সবাইকে খেলা দেখানো শুরু করলাম, তখন সবাই অবাক হয়ে সাপের খেলা উপভোগ করত। গত প্রায় পাঁচ বছরে সখিপুরে রাসেলস ভাইপারসহ বিষধর বিভিন্ন প্রজাতির সাপের উপদ্রব বেড়েছে। এসব সাপ মানুষের বসত বাড়িসহ ফসলি জমিতে বাস করে। সাপ দেখতে মানুষ ভয় পেয়ে আমাকে মোবাইলে খবর দিলে আমি গিয়ে সাপ উদ্ধার করে দেই। এ বছর রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন প্রজাতির শতাধিক সাপ ডিমসহ উদ্ধার করেছি। সাপের কামড়ে যখন মানুষ মারা যায়, তখন আমার খুব খারাপ লাগে। যখন সাপ ধরে সাপের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচতে পারি, তখন আনন্দ পাই।

তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে সাপ উদ্ধার করেছি। অনেক সময় বিষাক্ত সাপের ছোবলও খেয়েছি। কিন্তু আমি নিজের চিকিৎসা নিজেই করেছি। কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় আমি নিজেও কৃষক। বর্তমান সময়ে সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় কৃষিকাজ ঠিকমতো করতে পারছি না। প্রায় প্রতিদিনই আমাকে কোনো না কোনো বাড়ি বা ফসলি জমি থেকে সাপ উদ্ধার করে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। সাপ উদ্ধারের পর আমার গাড়ি ভাড়া ও সম্মানী হিসেবে কেউ এক হাজার আবার কেউ দুই হাজার টাকা দেয়। 

সাপ উদ্ধার করছেন সাপুড়ে মিনু ঢালীর শিষ্য বারেক মামুদ / ছবি : ঢাকা পোস্ট

মিনু ঢালী বলেন, সাপ উদ্ধারের পর আমি সাপের বিষদাঁত ভেঙে ফেলি। এরপর যারা সাপের খেলা দেখায়, তাদেরকে সাপগুলো দিয়ে দেই। আমার উদ্ধারকৃত একটি সাপ ভেনম রিসার্চ সেন্টারে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সখিপুরের চরাঞ্চলে যেভাবে সাপের উপদ্রব বেড়েছে, তাতে সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।

সাপুড়ে মিনু ঢালীর কাছ থেকে সাপ ধরার কৌশল শিখে এ বছর মল্লিক কান্দি, ডাক বাংলা রোড, মাঝি কান্দিসহ একাধিক এলাকা থেকে বিষধর সাপ উদ্ধার করেছেন বারেক মামুদ। জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে সাপুড়ে মিনু ঢালীর কাছে সাপ ধরার কৌশল রপ্ত করেছি। এরপর থেকে প্রায় এক হাজার সাপ উদ্ধার করেছি আমি। সাপগুলো উদ্ধার শেষে আমি মিনু ঢালীর কাছে পৌঁছে দেই। সাপ উদ্ধার করতে আমার ভয় লাগে না। কারণ মিনু ঢালী আমাকে সুন্দরভাবে কাজটি শিখিয়েছেন।

চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ও প্রশিক্ষক বোরহান বিশ্বাস রোমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাপুড়ে মিনু ঢালীর সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। আমি তার কাছ থেকে একটি রাসেলস ভাইপার প্রজাতির সাপ নিয়ে এসেছিলাম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে আমরা রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ দিয়ে নিজস্ব অ্যান্টিভেনম তৈরির জন্য সাপটি নিয়েছিলাম। রাসেলস ভাইপার পৃথিবীর বিষাক্ত সাপগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সাপ। সখিপুরের চরাঞ্চলে সাপের উপদ্রব বেশি। সবাইকে সচেতন হওয়া ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।

সখিপুরের বাসিন্দা রুহুল আমিন জুয়েল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাপুড়ে মিনু ঢালীকে আমার ছোট বেলা থেকেই দেখেছি সাপ উদ্ধার করতে। মিনু ঢালী যদি সখিপুরের বাসা বাড়ি ও ফসলি জমি থেকে সাপ উদ্ধার না করতো, তাহলে আরও অনেক প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটতো। আমরা চরবাসী তার জন্য দোয়া করি।

সখিপুরের ডিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহসীন হক বেপারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাপুড়ে মিনু ঢালীর সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। প্রায় সময়ই বাজারে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। বর্তমান সময়ে সখিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে সাপের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। মিনু ঢালী প্রতিদিন সাপ উদ্ধার করা কাজে ব্যস্ত এখন। সাপ উদ্ধার করা কৌশল তিনি দীর্ঘদিন ধরে জানেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি সাপ উদ্ধার করতে গিয়েছেন। তার উদ্ধারকৃত সাপ ভেনম রিসার্চ সেন্টারে নেওয়া হয়েছে। সখিপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে তিনি সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা করেছেন। আমি তাকে ধন্যবাদসহ শুভেচ্ছা জানাই।

এএএ