‘আমার বাবা-মা নেই। বাড়িতে স্ত্রী আর তিন মেয়ে। জলদস্যুরা জিম্মি করার পর বারবার মেয়েদের কথা মনে পড়ছিল। আমার কিছু হয়ে গেলে তারা কোথায় যাবে? তারা কার দরজায় দাঁড়াবে? আমি কি তাদের মুখ দেখতে পারব না! সন্তানরা কি আমায় বাবা বলে ডাকবে না?’

বুধবার (১৫ মে) রাতে জিম্মি হওয়ার ৬৭ দিন পর বাড়িতে ফিরে ঢাকা পোস্টকে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নোয়াখলা ইউনিয়নের সিংবাহুড়া গ্রামের মুন্সি বাড়ির মৃত সাখাওয়াত উল্লাহর ছেলে আহমেদ মো. সালেহ (৪৮)।

বুধবার বিকেলে নিজ বাড়িতে ফেরেন তিনি। বাড়িতে আসার পর তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন স্বজনরা। সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ। দুই মাসেরও বেশি সময় পর স্বজনরা তাকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ খুশিতে কাঁদতে থাকেন।

জানা যায়, চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে আহমেদ মো. সালেহ সবার বড়। তার স্ত্রী ও তিন মেয়ে সন্তান রয়েছে।

বড় মেয়ে রিয়াজুল জান্নাত তাসফি (১৪) চাটখিল পাঁচগাও উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। মেজো মেয়ে একই বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ফাহমিদা আক্তার ফাইজা (১২) এবং ছোট মেয়ে হাফসা বিনতে সালেহর বয়স মাত্র তিন বছর।

গত ১২ মার্চ দুপুরে সোমালিয়ার দস্যুরা আহমেদ মো. সালেহসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ জন নাবিককে জিম্মি করে। অস্ত্রের মুখে দস্যুরা সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখে। এরপর গত ১৪ এপ্রিল ভোরে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হন এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজসহ ২৩ নাবিক। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় জাহাজ থেকে নামলেও সব মিলিয়ে ৬৭ দিন পর নিজ বাড়িতে আসেন সালেহ। সালেহের ফিরে আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাকে এক নজর দেখার জন্য তার বাড়িতে ভিড় জমান। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর বাবাকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে তার তিন মেয়ে। তার ফিরে আসায় স্বজন ও প্রতিবেশীরা অনেকেই আনন্দ প্রকাশ করেন। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দীন ফুল নিয়ে দেখা করতে আসেন সালেহের বাড়িতে। এ সময় চাটখিল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ইমদাদুল হকও উপস্থিত ছিলেন।

জিম্মিদশার বিভীষিকাময় সময় স্মরণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আহমেদ মো. সালেহ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেঁচে ফিরব এটা ছিল আমাদের জন্য স্বপ্ন। এত অল্প সময়ের মধ্যে বাড়িতে আসব সেটা কল্পনাও করিনি। মহান আল্লাহর রহমত আর মানুষের দোয়া ছিল। আমাদের কোম্পানি এবং সরকারের সহযোগিতা ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার সন্তানদের কাছে আমাকে ফিরে আসতে সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।

বড় মেয়ে রিয়াজুল জান্নাত তাসফি ঢাকা পোস্টকে বলে, আজ আমরা ঈদের থেকেও বেশি খুশি। আমার বাবাকে আমরা কাছে পেয়েছি এর থেকে আনন্দের আর কিছু নেই। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। যারা আমার বাবাসহ সকল নাবিকের জন্য দোয়া করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই।

সালেহের চাচাতো ভাই মনির হোসেন সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সালেহ সব সময় পরিবার নিয়ে ভাবেন। বাড়িতে থাকলে মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটান। তিনি মেয়েদের সকল শখ পূরণ করেন। তার মসজিদ, মাদরাসা ও এতিমখানার প্রতি আলাদা টান রয়েছে। তিনি বাড়িতে ফিরায় আমরা সবাই খুশি।

সালেহের স্ত্রী তানিয়া আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের আগে আমার স্বামী মুক্ত হবেন বলে আশায় ছিলাম। কিন্তু মুক্ত হয়নি। আমার সন্তানদের ঈদ উদযাপনও হয়নি। অবশেষে আমার স্বামী বাড়িতে এসেছেন। মেয়েরা তার বাবাকে কাছে পেয়ে মহাখুশি। তাদের কাছে ঈদের আনন্দের মতো লাগছে।

চাটখিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি অনিশ্চিত জীবন থেকে ফিরে এসেছেন আহমেদ মো. সালেহ। আজ তার বাড়িতে গিয়ে ফুল দিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানালাম। তিনি জিম্মি থাকা সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন। এরপর তার মেয়েদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর তিন মেয়ে তাদের বাবাকে কাছে পেয়েছেন। যেকোনো প্রয়োজনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি। উপজেলা প্রশাসন আহমেদ মো. সালেহের পাশে সব সময় আছে।

এমজেইউ