প্রায় ৩০ বছর আগে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার সোনারায়ের খাটুরিয়া গ্রামের মাংস ব্যবসায়ী রহিম উদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সী নেহার বেগমের। বিয়ের দুই বছর না যেতেই তাদের ঘরে প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এরপর কোলে আসে আরও তিন কন্যা সন্তান। চার কন্যা সন্তানের পর জন্ম হয় ছেলে সন্তানের।

বেশ ভালোভাবেই কাটছিল তাদের সংসার জীবন। এরপর হঠাৎ করেই ২০০৫ সালে স্বামী রহিম উদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে না পেরে মারা যান তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন নেহার বেগম। এরপর চার মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।

তিন বেলার খাবার জোগাড় করতে বেছে নেন দিনমজুরির কাজ। প্রায় ২০ বছর ধরে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। দিনমজুরি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের দিয়েছেন পড়ালেখার খরচ। চার মেয়ের মধ্যে তিনজনকে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ছেলের লেখাপড়া চললেও টাকার অভাবে খরচ জোগাতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে মেয়ের লেখাপড়া। নিজেদের কোনো জমিজমা না থাকায় তাদেরকে দুই শতক জমি দান করেন রহিম উদ্দিনের ছোট ভাই জসিম উদ্দিন। সেই জমিতে একটি ঘর করে দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন নেহার বেগম।

তার ছোট ছেলে নাহিদ ইসলাম ২০২৩ সালে খাটুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে সৈয়দপুর সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ১ম বর্ষ পড়ছে আর মেয়ে রুনা আক্তার স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারেননি।

রোববার (১২ মে) দুপুর ১২টার দিকে নেহারের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি বাড়ির পাশেই সরকারের ইজিপিপি প্রকল্পের আওতায় ৪০ দিনের কর্মসূচিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রখর রোদে অনান্য শ্রমিকদের সঙ্গে মাটি কাটার কাজ করছেন নেহার বেগম। এ সময় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সংগ্রামী মা নেহার বেগমের।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী যখন মারা গেল তখন থেকে আমি মানুষের বাসায় কাজ করে সংসারের খরচ ও সন্তানদের লেখাপড়া চালাইছি। আমার আশা আছে যে আল্লাহ আমাকে একটা ছেলে দিয়েছে তাকে যেন কোনো কষ্ট করতে না হয়। যতই কষ্ট হোক কাজকর্ম করে ছেলেটাকে পড়ালেখা শেখাবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে একটা ঘর দিয়েছে সেই ঘরে সন্তানদের নিয়ে আমি থাকি। এখন আমার মনে অনেক আশা। আমার জীবনে যা কষ্ট গেছে, জীবন নষ্ট হইছে, কোনো কষ্ট যাতে আমার সন্তানের জীবনে না আসে। আশা করছি আমার ছেলে লেখাপড়া করে একটা চাকরি পাবেই।

নেহার বেগম বলেন, আমার সংসার চলছে মানুষের বাসায় কাজ করে। কখনো ২৫০ কখনো ৩০০ টাকা পাই। এভাবেই দিন চলছে। ছেলের পড়ালেখার খরচটা পাঁচ দিনের মজুরি এক জায়গায় করে তাকে দেই। নিজে কোনো কিছু না নিয়ে ছেলেটাকে দেই। আর মেয়েটাকে টাকার অভাবে ডিগ্রিতে ভর্তি করাতে পারিনি। আমরা তো লেখাপড়া করিনি গরিব মানুষ। আমার বাপ-মা আমাদের লেখাপড়া শিখাই নাই। মেয়েটাকে ভর্তি করাই দিলে ডিগ্রিতে পড়তো। ছেলেটাকে দেব নাকি মেয়েটাকে দেব। মেয়েটাকে দিলে ছেলেটাকে দেওয়া হয় না। ছেলেটাকে দিলে মেয়েটাকে দেওয়া না। মেয়েটাকে বলছি তোমার লেখাপড়ার দরকার নাই। যা পড়ছো পড়ছো, এখন তোমার ভাইটা লেখাপড়া করুক। এভাবে কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছি। জায়গা জমি আমার কিছুই নাই। দেবররা জমি দিয়ে সরকারের ঘরটা বসায় দিছে। সরকারের বিধবা কার্ডের টাকা পাই ১৫০০ টাকা করে। ওই টাকাটাও সন্তানদেরকেই দেই। কাপড়চোপড় লাগলেও ওটা করি। আর না নিলে বাচ্চাটাকে দেই। আমার কষ্ট হোক তবু ছেলেটা লেখাপড়া শিখুক। আল্লাহ আমাকে একটা ছেলে দিছে চার মেয়ের পর। এই ছেলেটাকে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখাই, যদি একটা চাকরি পায়। এটাই আল্লাহর কাছে চাওয়া।

নেহারের মেয়ে রুনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মা আমাকে কষ্ট করে লেখাপড়া করাইছে। আমার ভাইও লেখাপড়া করতেছে। আমি টাকার জন্য দুই বছর ধরে ডিগ্রিতে ভর্তি হতে পারিনি। আমরা পাঁচ ভাইবোন তার মধ্যে তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা লেখাপড়া করতে পারে নাই। আমার মা আমাকে কষ্ট করে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করাইছে। কিন্তু টাকার জন্য আর পারছে না। আমাকে পড়াতে গেলে আমার মা ভাইকে পড়াতে পারছে না। সমস্যা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে এবং সংসারে যে চাহিদা তা পূরণ করতে পারছে না। সরকারের কাছে আবেদন করছি আমার ভাইকে তারা যেন সহযোগিতা করে। তাকে যেন মানুষের মতো মানুষ করতে পারে আমার মা। সে যদি লেখাপড়া করে একটা চাকরি করতে পারে তাহলে আমার মায়ের কষ্টটা স্বার্থক হবে।

সোনারায় ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য বেলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রহিম উদ্দিন ভাই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তার স্ত্রী খুব কষ্ট করে এক ছেলে ও চার মেয়েকে বড় করেছেন। তার মধ্যে তিনটা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি  কোথায় থাকবেন, কি করবেন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটা ঘর তাকে দেওয়া হয়। তার ছেলেটা বাহিরে পড়াশোনা করে। সেখানকার খরচ যোগাতে গিয়ে মেয়েটার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের কাছে আমার আবেদন এই পরিবারের ছেলেমেয়ে উভয়ই যাতে লেখাপড়া করতে পারে সেই ব্যবস্থা যেন করা হয়।

খাটুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. মোফাজ্জল হোসেন শাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর আমাদের বিদ্যালয় থেকে ২৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার মধ্যে নাহিদ একজন। সে হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান, তারা সরকারি ঘরে বসবাস করে। তার বাবা অনেক আগে মারা গেছে। তার মা কষ্ট করে মানুষের বাড়িতে কাজ করে তাকে লেখাপড়া করাচ্ছে। ছেলেটি অনেক মেধাবী। সে এখানে ভালো রেজাল্ট করে সৈয়দপুর সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছে। তার মা লেখাপড়া জানে না কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল। সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করবে এই আশা নিয়ে সন্তানের জন্য কষ্ট করে যাচ্ছেন। 

আরএআর