প্রায় ১৬ বছর আগে দুই মেয়েসহ স্ত্রী রুনু বেগমকে ছেড়ে চলে যান স্বামী নান্টু। এরপর থেকেই জীবন যুদ্ধে নামতে হয়েছে বরগুনার রুনু বেগমকে। বড় মেয়ে ফাতিমাকে পড়াশোনা করাতে না পেরে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। তবে ছোট মেয়ে মিমকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন তিনি। পৌরসভার রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতনে কোনো রকম খেয়ে-পরে চলছেন। মেয়ের পড়াশোনার অতিরিক্ত খরচ যোগাতে তিনি কাজ করছেন এলাকার বিভিন্ন মানুষের বাসাবাড়িতে।

বরগুনা পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের জিলা স্কুল সংলগ্ন আমতলার পাড় নামক এলাকার সড়কের পাশে সরকারি জমিতে টিনের তৈরি একটি জরাজীর্ণ ঘরে থাকেন রুনু বেগম। বড় মেয়ের বিয়ে হওয়ায় ছোট মেয়েকে নিয়ে ওই ঘরে থাকেন তিনি। দুই মেয়ের বয়স যখন ৫ ও ২ বছর তখন রুনু বেগমকে ডিভোর্স দিয়ে স্বামী নান্টু অন্যত্র চলে যান। তবে বাবা ছেড়ে গেলেও দুই মেয়েকে ছাড়তে পারেননি মা রুনু বেগম। খেয়ে না খেয়ে বড় করেছেন মেয়েদের। তার নিজের চেষ্টায় জেলার মধ্যে ভালো স্কুল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ছোট মেয়ে মিম গত বছর এসএসসি পাস করেছে। বর্তমানে মিমকে ভর্তি করেছেন বরগুনা সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে। রুনু এখন স্বপ্ন দেখছেন মেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমজে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একদিন মায়ের পাশে দাঁড়াবে। এমন স্বপ্ন পূরণ করতেই তিনি পৌরসভার ঝাড়ু দেওয়ার কাজের পাশাপাশি কাজ করেন বিভিন্ন মানুষের বাসাবাড়িতে। 

রুনু বেগমের জীবন সংগ্রামের খবর জানতে সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ টিনের ঘরের মধ্যে সামনের একাংশে একটি চুলায় নিজেদের জন্য রান্না করছেন রুনু । বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাছ মাংস কেনার সামর্থ্য হয় না তার। যতটুকু সামর্থ্যে কুলোয় তা দিয়ে শাকসবজি ডাল আলু ভর্তায় চলে মা মেয়ে দুজনের তিন বেলার খাবার। ঘরের মধ্যে জায়গা সংকটে যে টেবিলে খাবার খেতে হয় সে টেবিলেই লেখাপড়া করতে হয় তার মেয়ে মিমকে। রাতে ঘরের একটি মাত্র খাটে একসঙ্গে ঘুমান মা ও মেয়ে। 

মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে রুনু বেগমের জীবন সংগ্রামের বিষয়ে প্রতিবেশী ফরিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রুনু বেগমকে মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করতে দেখি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় ইট ভাঙার কাজ করেন। এসব কাজ করে খেয়ে না খেয়ে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালান তিনি।

রোজী নামে আরেক প্রতিবেশী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই দেখি রুনু বেগম তার মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে কাজ করছেন মানুষের বাসায়। তবে বর্তমান সময়ে এ চেষ্টায় মেয়েকে নিয়ে রুনু র যে স্বপ্ন তা শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে পারবেন কিনা তা বলা যায় না।

বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে মায়ের চেষ্টায় লেখাপড়া করতে পেরে রুনু বেগমের ছোট মেয়ে মিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছোট থাকতেই আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এরপর থেকেই আমার মা মানুষের বাসায় বাসায় কাজসহ পৌরসভায় রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করে আমাকে বড় করেছেন, পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন। বর্তমানে আমি একদশ শ্রেণিতে পড়ি। লেখাপড়া শেষ করে মায়ের পাশে দাঁড়াতে চাই আমি।

রুনু বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী চলে যাওয়ার পর মেয়েদের নিয়ে আমি অনেক কষ্ট করেছি। এক মেয়েকে বিয়ে দিলেও তিন বেলা ঠিকমতো না খেয়ে টাকা বাঁচিয়ে ছোট মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছি। এখন কলেজের খরচ যেগাতে হিমশিম খেতে হয় আমাকে। মানুষের বাসায় কাজ করে এবং রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায় সংসারের খরচ চালিয়ে অনেক সময় মেয়ের প্রাইভেট পাড়ানোর টাকা হাতে থাকে না। কলেজে আসা-যাওয়ার খরচ তো দিতেই পারি না। অনেক কষ্ট করে মেয়েরও লেখাপড়া করতে হচ্ছে। তারপরও খেয়ে না খেয়ে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। 

বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যম ও আমাদের নিজেদের খোঁজে বিভিন্ন অসহায় মানুষদের সন্ধান পেয়ে থাকি। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বরগুনায় ৮ শতাধিক মানুষকে ঘর দেওয়া হয়েছে।রুনু বেগমের বিষয়টি জেনেছি। তার যদি কোথাও নিজের কোনো জমি না থাকে তাহলে আমরা সুযোগ পেলে তাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেব। এছাড়া রুনু র মেয়ের পড়াশোনা করতে বিভিন্ন উপকরণসহ যে কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তাকে সহযোগিতা করতে। এর বাহিরেও সরকারের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বিষয়ক প্রকল্পের মাধ্যমে তাদেরকে স্বাবলম্বী করতে সহযোগিতা করা হবে।

আব্দুল আলীম/আরএআর