অসিফা বেগম

‘গৃহস্থ পরিবারে বিয়ে হয়েছিল। খোলানে ধান, পাট ও আখের কাজ বছরের সিংহভাগ সময় থাকতো। শ্বশুরের ঘোড়া, গরু, মহিষ থেকে শুরু করে সব গৃহপালিত পশু ছিল। দিনভর দুই হাতে কাজ ঠেলে অসময়ে আর খাবার পেটে ঢুকতো না। এভাবে কখনো অর্ধহারে। আবার কখনো অনাহারে দিন গেছে। এরই মধ্যে বড় ছেলে পেটে। গর্ভবতী অবস্থায় ক্ষুধায় মাথা ঘোরে। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারি না, শরীর থর থর করে কাঁপে। একে তো পেটে ভাত নাই, আবার শরীর দুর্বল। তার মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে প্রসব বেদনা। অসহ্য কষ্টের মধ্যে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো কানে। নিমিষেই কষ্টের অশ্রু খুশিতে পরিণত হলো সন্তানের মুখ দেখে।’

এভাবেই প্রথম সন্তান জন্মের সময় কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী নগরীর বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা অসিফা বেগম (৫৯)। তিনি বলেন, সন্তানের মা না হলে নারীর পূর্ণতা আসে না। মা হলেই একজন নারীর জীবনের সব স্বাদ পূরণ হয়।

অসিফা বেগমের দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। তার স্বামী মোশাররফ হোসেন ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। পাঁচ ছেলে-মেয়ের বিয়ে হয়েছে। পাঁচটি সন্তান জন্মদানে এই মায়ের পাঁচ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রথম দুই সন্তান মায়ের বাড়িতে হলেও পরের তিন সন্তান শ্বশুরবাড়িতে জন্ম নিয়েছে।

আঠারোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা অসচ্ছল স্বামীর সংসারের বোঝা টানতে হয়েছে অসিফাকে। মুদির দোকানদার স্বামীর সংসারে যোগান দিতে হয়েছে গবাদিপশু পালনের মধ্য দিয়ে। তিনজনের সংসার চালাতে হিমসিম খাওয়া স্বামীর পাশে সব সময় দাঁড়িয়েছেন এই নারী। শ্বশুরের জায়গা- জমি থাকলেও ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগাভাগি না হওয়ায় খুব সামন্য জমিতে ফসল ফলিয়ে চলা তাদের জন্য খুব কষ্টকর ছিল।

অসিফা বেগম বলেন, এলাকার মধ্যে শ্বশুরের জায়গা-জমি বেশি ছিল। গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে ফাঁকে সারতে হতো রান্না বান্নার কাজ। খোলানে ধান, পাট ও আখের কাজ বছরের সিংহভাগ সময় থাকত। শ্বশুরের ঘোড়া ছিল। ছিল গরু, মহিষ থেকে শুরু করে গৃহপালিত সব ধরনের পশু। শ্বশুর এলাকার মণ্ডল হওয়ার সুবাদে সব সময় মানুষের আশা-যাওয়া ছিল। ফলে বাড়ি ভর্তি মানুষ সব সময় থাকত। আর আগে সব মানুষের খাবারের কষ্ট হত। সব মিলিয়ে সময়ের খাবার সময়ে পেতাম না। দিনভর দুই হাতে কাজ ঠেলে অসময়ে আর খেতে পারতাম না। এমনভাবে কখনো অর্ধহারে। কখনো অনাহারে দিন গেছে।

অসিফা বেগম বলেন, যারা মা হয়েছে তারাই যানে সন্তান গর্ভধারণের পর নানা ধরনের অসুবিধা হয়। চলাফেরা করতে পারতাম না। ফলে দুই পা ফুলে উঠেছিল। গর্ভাবস্থায় একটার পর একটা অসুখ লেগেই ছিল। স্বামী সারাদিন দোকানে থাকে। শুধু খাওয়ার সময় বাড়িতে আসে। এমন অবস্থায় অসুস্থ শরীরে শ্বশুড়বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজ করতে হয়েছে। সেই সময় কষ্টের কমতি ছিল না। তখনকার মানুষ চিকিৎসা বুঝতো না। খুব জটিল সমস্যা হলে মেডিকেলে যেত। সব সময় আল্লাহর কাছে চাইতাম। আল্লাহ সন্তানটা সুস্থভাবে দিও। সুস্থ সন্তান।  

তিনি বলেন, স্বামীর বাড়ি রাজশাহী শহরে হলেও বাবার বাড়ি গোদাগাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। প্রথম সন্তান সাধারণত নারীদের মায়ের বাড়িতে হয়। আগে যোগাযোগের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দিনে একবার ট্রেন রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেত। মহানন্দা নামের এই ট্রেনে কাঁকনহাটে স্টেশনে নামতে হতো। তারপরে বাবার বাড়ি থেকে গরুর গাড়ি আসতো স্টেশনে নিতে। এরপর গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠে গরুর গাড়িতে পাড়ি দিয়ে কাদা-পানির মধ্যে দিয়ে যেতে হতো বাবার বাড়ি। সন্তান সম্ভাবা অবস্থায় এমন রাস্তা পাড়ি দিয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা মনে হলে বুকের মধ্যে কেঁদে ওঠে।

এই মায়ের পাঁচ সন্তান। তারা হলেন, আতিক, আশিক, সুমি, শম্পা ও সাবরিনা। তাদের বিয়ে হয়েছে। তাদের মধ্যে আতিকের দুই মেয়ে, আশিকের এক ছেলে, সুমির এক মেয়ে, সম্পার দুই ছেলে-মেয়ে ও সাবরিনার দুই ছেলে। মাকে নিয়ে পাঁচ সন্তানের পাঁচ রকমের ভাবনা ও ভালোবাসা। মাকে কেউ কম ভালোবাসা। কেউ বা বেশি ভালোবাসা। তবে সব সন্তানই মাকে ভালোবাসে। 

মায়েরা আসলে শেষ বয়সে সন্তানদের থেকে শুধু একটু যত্ন ও ভালোবাসা চায় উল্লেখ করে অসিফা বেগম বলেন, মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে থাকে। চাইলে মাকে দেখতে আসতে পারবে না। কিন্তু ছেলেরা বাড়িতে থাকে। সারাদিনে মায়ের সাথে বেশি না, একবার বা দুই বার দেখা করে কথা বলবে এটাই চাই।  

মেজো ছেলের সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে অসিফা বেগম জানান, তিনি চাননি তার কোনো ছেলে এই পেশায় আসুক। কিন্তু ছেলের বাবা প্রথমে না চাইলেও পরের দিকে চাইতো। ছেলে এই পেষায় থাকুক। দেখছি তো এখন ছেলের এই পেশায় রুটি-রুজি হচ্ছে। আগের না চাওয়া এখন চাওয়ায় পরিণত হয়েছে। ছেলেকে মানুষ সম্মান করে, ভালোবাসে। ছেলে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে। মানুষের উপকার ও মানুষের পাশে দাঁড়ালে একটু কষ্ট হবেই। এটা ক্ষণিকের জন্য।
 
মেজো ছেলে শাহিনুল আশিক বলেন, মা বলতো ব্যাটা এই কাজটা (সাংবাদিকতা) বাদ দিলে হয় না। যে বেতন পাচ্ছিস তাতে কীভাবে চলবি। অনেক সময় সাংবাদিকদের মেরে ফেলে কারও বিরুদ্ধে নিউজ করলে। বাপ তুই মরলে কী হবে আমাদের। বাপ তুমি কাজটা ছেড়ে দাও। অন্য কাজ খুঁজো। আল্লাহর দুনিয়াতে অনেক কাজ আছে, চাকরি আছে। কষ্ট করে মানুষ করেছি, বাপ তুমি সাবধানে থেকো।

পরিবারের বড় ছেলে ব্যবসায়ী মো. আতিক বলেন, প্রতিটি পরিবার একেকটি গল্পের ভান্ডার। প্রতিটি পরিবারে সুখ-দুঃখের গল্প আছে। কারও কম আবার কারও বেশি। তবে প্রতিটা পরিবারে প্রত্যেকের অবদান রয়েছে। এক সময় আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়ল। সেই সময় আমি ষষ্ট বা সপ্তাম শ্রেণিতে পড়ি। তখন নিজের লেখাপড়া ছাড়াও বিনোদপুর বা কাটাখালী থেকে দোকানের বাজার করে নিয়ে এসে দোকান চালাতাম রাত ১০টা পর্যন্ত। দোটানায় পড়ে সেই সময় লেখাপড়া ঠিকভাবে করতে পারিনি। পরে এইচএসসি পাস করেছি। তবে তখন ছোট ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ চলাতে হয়েছে। সেই জায়গা থেকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ছোট বোন সুমি। সে এনজিওতে চাকরি করত। পরবর্তী সময়ে পুরো সংসার চালিয়েছে সে।

শাহিনুল আশিক/আরএআর