‘ছেলের দিকে তাকিয়ে বুকে পাথর বেঁধে লড়াই করেছি’
‘তখন আমার বাবার (ছেলে) বয়স ছয় বছর। সে অনেক কিছু বুঝতো না। ঢাকা থেকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার বাড়িতে উঠেছি। আমার দুই ভাই আমাকে সাহস জুগিয়েছে। শিশু অপুই আমার আশার সম্বল, তাকে দেখে সব ভুলে যাই। আজ সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ছেলে আমার বড় কর্মকর্তা হয়েছে। কখনো চোখের আড়াল হতে দেইনি। এক কথায় ছেলের দিকে তাকিয়ে বুকে পাথর বেঁধে লড়াই করেছি।’
কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের বনিক বাড়ির বাসিন্দা তরুলতা বনিক।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, ১৯৯৬ সালের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে ৬ বছরের শিশু অপু বনিককে নিয়ে ঢাকা থেকে বেগমগঞ্জ চলে আসেন মা তরুলতা বনিক। তারপর চলে টিকে থাকার লড়াই। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। তবে দমে যাননি তিনি। শত কষ্টেও চালিয়ে নিয়েছেন সংসার। দুই ভাই সমরেশ চন্দ্র বনিক ও সমির চন্দ্র বনিকের সহযোগিতায় ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাখেন তরুলতা। স্কুল পেরিয়ে কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়। কোথাও চোখের আড়াল হতে দেননি তিনি। ২০০৯ সালে ছেলেকে ভর্তি করান নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগে। পড়াশোনা শেষ করে ৩৫তম বিসিএসে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হন অপু বনিক। তারপর থেকে আর কষ্ট করতে হয়নি তরুলতা বনিককে।
সংগ্রামী মা তরুলতা বনিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, একমাত্র সন্তান অপু বনিককে নিয়ে কি কঠিন সময় পার করেছি তা কেবল আমি জানি। আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। অনুকূলে চলার অভিজ্ঞতা সহজ, কিন্তু প্রতিকূলে চলার পথ অনেক কঠিন। কেবল যারা চলেছে তারাই বুঝতে পারে। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর ভয় কাজ করতো কখন আমার মানিককে নিয়ে যায় বা কোনো ক্ষতি করে। ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেইনি। আমার দুই ভাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। তারা না থাকলে আমাকে খুঁজেও পেতো না। আর অপুও মানুষের মতো মানুষ হতো না।
তিনি আরও বলেন, অপু বনিককে আমি এখনো চোখের আড়াল হতে দেই না। আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। তার স্বপ্ন জয় হয়েছে। সে নিজের জন্য কিছু করার পাশাপাশি মানুষের জন্য করতে পারছে। এটা আমাকে আনন্দ দেয়। আমি সব অতীত ভুলে গেছি। কষ্টের দিন ফুরিয়েছে। আমার ছেলেকে নিয়ে আমার গর্ব হয়। সৃষ্টিকর্তা আমার মতো কাউকে এমন কষ্টের অতীত না দিক। আমার ছেলের জন্য দোয়া চাচ্ছি।
তরুলতা বনিকের বড় ভাই সমরেশ চন্দ্র বনিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশে চাকরি করেন এমন একজনের সাথে আমার বোনকে বিয়ে দেন বাবা। বাবার আশা ছিলো বোন যেন স্বামীর ঘরে সুখে শান্তিতে থাকে। অনেক লড়াই করেও আমার বোনের সংসার করা হয়নি। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে সে। সেই ছেলের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের সুন্দর সময়টুকু কষ্টে পার করেছে বোন। সমাজে নারীর যুদ্ধটা মানুষ সুন্দরভাবে নেয় না। এখনো তার মূল্যায়ন নেই। আমার বোন রত্নগর্ভা। ছেলেটা অত্যন্ত মেধাবী। সারাদিন টিউশনি করে রাতে নিজের পড়ালেখা করতো। নিজের চেষ্টায় সে চুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। আমার বোন ছেলেকে চোখে চোখে রাখার জন্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছে। আমার বোন তার ছেলেকে নিয়ে সুখে শান্তিতে আছে। এটাই আমাদের আনন্দ।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এলাকার সন্তান অপু বনিক। তার মা তরুলতা বনিকের সংগ্রাম আমরা দেখেছি। অপু বনিকের সাথে বড় হওয়া অনেকেই আজ ভালো অবস্থানে যেতে পারেনি, যেমনটা সে পেরেছে। তার মায়ের ভালোবাসা আর ইচ্ছাই তাকে সফল করেছে। সচরাচর এমন টা হয় না। আমরা জানি বিচ্ছেদ হলে সন্তানরা বখাটে হয়ে যায়। তারা সমাজের আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। কিন্তু অপু বনিক সফল হয়ে মায়ের সংগ্রামকে স্বার্থক করেছে। অপু এখন মানুষের পাশে দাঁড়ায়। অসহায়দের সহযোগিতা করে। এসব দেখে আমার বুক ফুলে ওঠে।
অপু বনিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মা কখনো বাবার অভাব আমাকে বুঝতে দেননি। তিনি আমাকে আগলে রাখতেন। রাতে ঘুমালে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার প্যান্ট বেঁধে রাখতেন। আমাকে যেন কেউ রাতে না নিয়ে যায়। আমি সারাদিন টিউশনি করলেও আমার মা আমাকে রেখে খেতেন না। গাছের প্রথম ফলটা তিনি আমাকে আগে খাওয়াতেন। আমার মা ছিলেন আমার শক্তি। তিনি আমাকে সাহস যোগাতেন এবং আমার সফলতায় খুশি হতেন। বিসিএসের চাকরি পাওয়ার পর মা সর্বোচ্চ খুশি হয়েছেন। আমি মায়ের ভালোবাসার শক্তি দিয়ে বাকিটা জীবন পার করতে চাই।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, সন্তানের সফলতায় প্রতিটা মায়ের পরিশ্রম থাকে। কারোটা আমরা জানি কারোটা আমরা জানি না। অপু বনিক আমার বেগমগঞ্জ উপজেলার কৃতী সন্তান ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী। তার মায়ের সংগ্রামের সফলতা সে নিজেই। সে অনেকের অনুপ্রেরণা। তার পুরো জীবনে যারা তাকে সহযোগিতা করেছে সাহস যুগিয়েছ তাদেরকে সম্মান জানাচ্ছি। পাশাপাশি অপু বনিক যেন তার মাকে দেখে রাখেন এবং চোখের আড়াল হতে না দেন সেই কামনা করছি। মা দিবসে সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
হাসিব আল আমিন/আরএআর