‘চার সন্তানকে রেখে চার বছর আগে মারা যান আমার স্বামী। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেকেই অনেক ধরনের কথা বলেছেন, কিন্তু কেউ আমার সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেননি। বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজি ও হাঁস মুরগি পালন করে প্রথমে ছেলেমেয়েকে খাইয়েছি। এরপর ওরা বড় হতে থাকলে খরচ বাড়লেও আমার আয় বাড়েনি। খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করেছি। এরপর হাঁস-মুরগি বিক্রি করে একটি সেলাই মেশিন কিনে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছি। মেজো মেয়ে আজ এসএসসি পাস করেছে। মা দিবসে এটা আমার কাছে আনন্দের সংবাদ। কিন্তু সন্তানদের ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়ানোর মতো কিছু নেই আমার ঘরে।’ 

এভাবেই নিজের জীবন-সংগ্রামের কথা বলছিলেন সংগ্রামী মা তাসলিমা বেগম। তিনি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের সরদারকান্দি গ্রামের মৃত দুলাল সরদারের স্ত্রী। 

স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩০ বছর আগে টেক্সিক্যাব চালক দুলাল সরদারের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সী তাসলিমা বেগমের। বিয়ের পর কয়েক বছর বেশ ভালোভাবেই কাটছিল তাদের সংসার জীবন। এরপর হঠাৎ করেই স্বামী দুলাল সরদার স্ট্রোকজনিত কারণে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। স্বামীর চিকিৎসার জন্য নিজেদের সামান্য পুঁজিসহ ঋণ করে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় করলেও ৪ বছর আগে মারা যান দুলাল সরদার। এরপর চার সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তাসলিমার সংগ্রামী জীবন। 

স্বামী মারা যাওয়ার পরে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের কটু কথা বলেছে তাসলিমাকে। কিন্তু সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাসলিমা সেসব কথায় কর্ণপাত করেননি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য তাসলিমা বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজি চাষ ও হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন। খুব কষ্টে ছোট সন্তানদের খরচ এসবে কোনো মতে হলেও সন্তানরা একটু বড় হলে তাসলিমা পড়েন বিপাকে। এরপর তিনি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। বাড়ির আঙিনার শাক-সবজি ও সেলাইয়ের উপার্জন দিয়ে তাসলিমা বেগম তার চার সন্তানকে বড় করেছেন। তার বড় ছেলে ইয়াসিন আরাফাত বর্তমানে ঢাকার একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। বড় মেয়ে আয়শা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়ে হাবিবা খাতুন এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছে। ছোট মেয়ে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। বাবার অবর্তমানে তাসলিমা বেগম ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে যে কষ্ট করেছেন তা সাধারণত দেখা যায় না। বর্তমানে তার বসবাস ভাঙা একটি টিনের ঘরে।

তাসলিমা বেগমের মেজো মেয়ে হাবিবা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবা যখন মারা যান, তখন আমরা অনেক ছোট। মা আমাদের খেতে দিয়ে নিজে এক হিসেবে না খেয়ে থাকতেন। বাড়ির হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি ও সেলাইয়ের উপার্জনের টাকায় আমরা পড়াশোনা করেছি। আজ আমার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি। ফলাফল মোটামুটি ভালোই হয়েছে। বর্তমানে আমি শিশুদের টিউশনি করিয়ে মাকে সংসারে সহযোগিতা করি। আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। আমি পাস করেছি শুনে মা কেঁদেই ফেলেছেন। আমি আমার মায়ের জন্য দোয়া চাই। বড় হয়ে মাকে একটি ঘর নির্মাণ করে দেব। যেন মায়ের ভাঙা ঘরে থাকতে না হয়।

তাসলিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পরে আমি মনে হয় নদীতে পড়ে গেছিলাম। একদিকে স্বামীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ঋণের বোঝা, অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের খাবার খরচ। আমি বাড়িতে শাক-সবজি চাষ ও হাঁস-মুরগি পালন করে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনো করিয়েছি। সেলাইয়ের কাজ করেছি। বড় ছেলেকে বেশি পড়াশোনা করাতে না পারলেও বর্তমানে সে মোটামোটি ভালো আছে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। মেজো মেয়ে আজ এসএসসি পাস করেছে। আজ মা দিবস। আমার মেয়ে আজ যে সুসংবাদ আমাকে দিয়েছে, তাতে আমি আমার কষ্ট ভুলে গেছি। আমার সন্তানরা আরও বড় হবে, মা দিবসে এটাই আমার প্রত্যাশা।

তাসলিমা বেগমের প্রতিবেশী ফুলু বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে রেখে তাসলিমার স্বামী মারা যাওয়ার পরে সে অনেক কষ্ট করেছে। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন ও সেলাইয়ের কাজ করে সে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছে। এমন প্রত্যন্ত গ্রামে এত কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে আমি আর দেখিনি। তাসলিমার জন্য দোয়া করি।

শরীয়তপুরের সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক বিশ্বজিৎ বৈদ্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, অসহায়দের পাশে থাকা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের দায়িত্ব। মা দিবসে সংগ্রামী মা তাসলিমা বেগমকে আমি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। তার পাশে থাকবে সমাজসেবা কার্যালয়।

সাইফ রুদাদ/আরএআর