যশোরের ঝিকরগাছা পৌর শহরের কৃষ্ণনগর বনফুল কলোনি এলাকার বাসিন্দা সাবিনা ইয়াসমিন (৪০)। তার স্বামী ওহেদুল ইসলাম ১২ বছর আগে ব্রেনস্ট্রোক করে প্যারালাইসড হয়ে ঘরে শয্যাশায়ী। এ হতদরিদ্র বাবা-মায়ের তিন মেয়ে এবং এক ছেলে রয়েছে। স্বামী শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ার পর ছয় সদস্যের সংসার ও ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার হাল ধরেন তাদের মা সাবিনা ইয়াসমিন। তিন বেলার খাবার আর সন্তানদের বই-খাতা কেনার অর্থ জোগাড় করতে বেছে নেন দিনমজুরির কাজ।

২৩০ টাকা দৈনিক মজুরিতে আফিল জুটমিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। জুটমিলে কাজ করে বাড়িতে ফিরে কুড়াল দিয়ে কাঠ ফেড়ে জ্বালানি কাঠ প্রস্তুত করে তা হোটেলে সরবরাহ করেন। এ কাজে তিনি হোটেল থেকে পান দৈনিক মাত্র ৫০ টাকা। সবমিলিয়ে দৈনিক ২৮০ টাকায় চলে পরিবারের খাবার আর সন্তানদের পড়াশোনা। অসুস্থ স্বামীর জন্য কখনো ঔষধ কিনতে পারেন আবার কখনো কিনতে পারেন না।

সরেজমিনে শনিবার (১১ মে) কৃষ্ণনগর বনফুল এলাকায় সাবিনা ইয়াসমিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার অসুস্থ স্বামী শুয়ে আছেন। তাদের ঘরটিও বসবাসের অনুপযোগী। পুরাতন টিন, প্লাস্টিকের বস্তা আর কাঠ দিয়ে কোনোরকমে বেড়া দেওয়া হয়েছে ঘরে। কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানিতে বিছানার অনেকটা ভিজে গেছে। ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছে বৃষ্টির পানি। দুপুর ২টা পার হলেও সাবিনা ইয়াসমিনের রান্নাঘরে নেই রান্নার কোনও আয়োজন। তিনি অসুস্থ স্বামীর দেখভাল করা নিয়ে ব্যস্ত।

স্বামীর পাশে বসে চোখ মুছতে মুছতে চার সন্তানকে শিক্ষিত করা, পরিবারের হাল ধরা নিয়ে সংগ্রামী জীবনের বর্ণনা দেন এ প্রতিবেদককে।

সাবিনা ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে জানান, তার স্বামী জর্দার ব্যবসা করতেন। ১২ বছর আগে ব্রেনস্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ার পর সন্তানদের পড়াশোনা আর সংসারের হাল ধরতে উপার্জনের পথে নামেন তিনি। বড় মেয়েকে অনার্স শেষ করিয়ে সাত বছর আগে ভালো ঘরে বিয়ে দেন। বড় মেয়ের স্বামী মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে চাকরি করেন। মেজো মেয়েকেও চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ভালো ঘরে বিয়ে দেন। তার স্বামী জামাই বায়িং হাউজের ইঞ্জিনিয়ার। তবে ছোট ছেলের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা জমা দেওয়ায় মেজো মেয়ের অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা ফরম পূরণ করতে দিতে পারেননি। ফলে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারেনি মেজো মেয়ে।

অন্যদিকে সাবিনা ইয়াসমিনের একমাত্র ছেলে আলমুন হাসান (১৮) ঝিকরগাছার এমএল স্কুল থেকে ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে চান্স পান। বর্তমানে আলমুন সেখানে তৃতীয় সেমিস্টারে পড়াশোনা করছেন। ছোট মেয়ে ঝিকরগাছার সম্মিলনী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

আমার ছেলেটা রোজার সময় চিড়া দিয়ে সেহরি, ইফতারি করেছে। বাবা তুমি কি খাইছো জিজ্ঞাসা করলে, ও বলে- আম্মু চিড়া খাইছি, চিড়া তো ভাতের মতোই।

সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ছেলে সাতক্ষীরা পলিটেকনিক কলেজে পড়াশোনা করে। ও সেখানে মেসে থাকে। আমি প্রতি মাসে ওকে ২ হাজার টাকা দেই। মেসে ৫০০ টাকা সিট  ভাড়া দেয়, আর বাকি টাকা কারেন্ট বিল, পানি বিল দিয়ে মাস কোনোরকমে পার করে। খাওয়ার জন্য তাকে বাড়তি কোনও টাকা দিতে পারি না। ও চিড়া কিনে রাখে। মাঝেমধ্যে চিড়া খায়।

তিনি বলেন, তার বাবা যখন বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন খবর শুনে ঈদের আগে বাড়িতে এসেছিল। গত বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা চলে গেছে। চলে যাওয়ার দিন আলু ভাজি, আর দুই কেজি চিড়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারিনি। আমার ছেলেটা রোজার সময় চিড়া দিয়ে সেহরি, ইফতারি করেছে। বাবা তুমি কি খাইছো জিজ্ঞাসা করলে, ও বলে- আম্মু চিড়া খাইছি, চিড়া তো ভাতের মতোই।

সাবিনা ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামী অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ায় গত এক মাস ধরে কাজে যেতে পারছি না। পাড়া প্রতিবেশীরা, কেউ কেউ ২০, ৫০, ১০০ টাকা দেয়। এ দিয়েই বাজার সদাই আর স্বামীর জন্য ঔষধ কিনে থাকি। কখনো বাজার করতে পারি আবার কখনো না খেয়ে থাকতে হয়।

ছেলে-মেয়েদের কাছে আমার কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই। তাদের কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছি, তারা অসুস্থ বাবা-মাকে দেখলে দেখবে। কিন্তু আমি চাই আমার সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হোক, তারা নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াক

দারিদ্র্য ও নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে চার সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে পারার অনুভূতি এবং শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ছেলে-মেয়েদের কাছে আমার কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই। তাদের কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছি, তারা অসুস্থ বাবা-মাকে দেখলে দেখবে। কিন্তু আমি চাই আমার সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হোক, তারা নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াক, আমাদের মতো তাদের যেন মানুষের কাছে হাত পাততে না হয়। আমার চারটি সন্তান কখনো খারাপ পথে যায়নি, আর কোনোদিন যাবে না, আমি বিশ্বাস করি।

ঝিকরগাছার স্থানীয় বিশিষ্ট সমাজসেবক সেবা সংগঠনের সভাপতি আশরাফুজ্জামান বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ পরিবারটি সম্পর্কে আমি কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি। আমার এলাকায় তাদের বাসা। আমি জানতে পারার পর চেষ্টা করছি, ছেলেটার পড়াশোনার দায়িত্বটা আমরা নিতে পারি কিনা। চেষ্টা করছি সাবিনা ইয়াসমিনকে কোনও ব্যাবসায়িক পুঁজি দেওয়া যায় কিনা।

তিনি বলেন, সাবিনা ইয়াসমিন একজন সফল মা। তিনি এত প্রতিকূলতা পেরিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মেয়েদের শিক্ষিত করে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। এটি সমাজের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। আমরা চাইবো আমাদের সমাজে যেসব সংগ্রামী মায়েরা আছেন তাদের পাশে যেন সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন।

পিএইচ