সংসার-চাকরি সামলে সন্তানদের ‘সম্পদ’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি
দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফেনী সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের চেওরিয়া গ্রামের মুক্তি নাথ। নিজেকে গড়ার বয়সে হাল ধরেন সংসারের। তার প্রথম সন্তান জন্মদানের ১৫ দিনের মাথায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পান তিনি। তবে সেই সময়ে নবজাতক সন্তানকে ঘরে রেখে ও পরিবার সামলিয়ে চাকরিতে যোগদান করা নিয়ে দেখা দেয় শঙ্কা। তবুও নিজের অদম্য ইচ্ছে শক্তি, পরিশ্রম ও একাগ্রতায় সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজের শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি সন্তানদের গড়েছেন তুলেছেন সম্পদ হিসেবে।
রোববার (১২ মে) বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে নিজের সন্তানদের গড়ে তুলতে সংগ্রামী পথচলার কথা তুলে ধরেন মুক্তি নাথ।
বিজ্ঞাপন
মুক্তি নাথের তিন সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে বড় ছেলে সুব্রত নাথ বর্তমানে ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় ছেলে সুমন কুমার নাথ কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আয়োজন এসিএম আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম দলের সদস্য। তিনি ১৯৯৮ সালে বুয়েটের সিএসই ডিপার্টমেন্ট থেকে সিজিপিএ ৪ নিয়ে পাস করেন। বর্তমানে তিনি মাইক্রোসফটে রিসার্চ ম্যানেজার এবং একমাত্র মেয়ে সুস্মিতা ভৌমিক অস্ট্রেলিয়ায় চাকরি করছেন।
মুক্তি নাথ পরিবারে সন্তান জন্মদানের পরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়ে শুরু করেন স্বপ্ন বুনন। তবে অনেক চড়াই-উতরাই ও সংগ্রাম করে তিন সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই স্বপ্নজয়ী মা।
শুরুর পথচলায় নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরে মুক্তি নাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন সকাল ৫টায় ঘুম থেকে উঠে ঘরের রান্নাবান্না শেষ করে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যেতাম। আমার ক্লাসের ফাঁকে খাবার খাইয়ে সেখানেই ঘুম পাড়িয়ে দিতাম। এটি নিয়ে অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা করতে হয়েছে। তারপরও নিরুপায় হয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো।
তিনি বলেন, বিদ্যালয় থেকে ফিরে তাদের ঘুম পাড়িয়ে আবার বাড়ির সব কাজ করতাম। সন্ধ্যায় রান্নাবান্নার পাশাপাশি তাদের পড়ালেখাও দেখতে হতো। তিন সন্তানকে কখনো টাকা-পয়সা বা ধন-সম্পদ দেওয়ার মতো সেই সুযোগ আমার ছিল না। শুধুমাত্র লেখাপড়া করানোই একমাত্র লক্ষ্যই ছিল। পড়ালেখা করিয়ে তাদের একটি অবস্থান তৈরি করে দেওয়ার জন্যই সবসময় চাইতাম। যখন তাদের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হতো তখন অন্যরা হাসলেও আমি কান্না করতাম। সৃষ্টিকর্তা আমার চাওয়াগুলো পূরণ করতেন এজন্যই তখন খুশিতে চোখে জল আসতো।
সন্তানদের গড়ে তোলার পেছনে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে মুক্তি নাথ বলেন, বড় ছেলেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। পরিবার থেকে তাকে ফেনীতে রেখেই পড়ানোর কথা বলেছিল। তখন আমি খেয়ে বা না খেয়ে হলেও ছেলেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর প্রতিজ্ঞা করি। পরে শ্বশুরকে অনেক অনুরোধ করে এ বিষয়ে রাজি করিয়েছিলাম।
মুক্তি নাথ বলেন, চাকরি করে আরাম-আয়েশে থাকব বা নিজের জন্য কিছু করব এমন চিন্তা কখনো করিনি। তাদের সব সময় বলেছি কখনো কারো উপকার করতে না পারলেও অপকার বা ক্ষতি করবে না। সন্তানদের জন্য এতোসব কষ্টও তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের কাছে কষ্ট মনে হয়নি। নিজের শ্রমের পাশাপাশি উপরওয়ালার আশীর্বাদ না থাকলে তাদের এতদূর নিয়ে আসতে পারতাম না।
মা-বাবাদের উদ্দেশ্যে এ সংগ্রামী মা বলেন, সন্তানদের আদরের পাশাপাশি শাসনেরও প্রয়োজন আছে। তবে অতিরিক্ত আদর বা শাসনেও অনেক সময় সন্তান বিপদগামী হয়ে যায়। এজন্য তাদের বুঝাতে হবে।
সমাজের প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের উদ্দেশ্যে মুক্তি নাথ বলেন, সন্তানরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের ঘরে আবার সন্তান এলে যেভাবে স্নেহ, মায়া মমতা দিয়ে আগলে রাখে ঠিক সেইভাবে বেঁচে থাকা মা-বাবার সঙ্গে আচরণ করবে। কোনো মা-বাবাই যেন বৃদ্ধ বয়সে সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই পেতে না হয়। মা-বাবা সন্তানের কাছে গাড়ি-বাড়ি বা ভালো খাবার চায় না। তারা সন্তানদের কাছ থেকে শুধু একটু ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করে। মা-বাবার এইসব প্রত্যাশা পূরণে সন্তানের খুব বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র আন্তরিকতার প্রয়োজন।
মায়ের অবদানের কথা উল্লেখ করে বড় ছেলে ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত নাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যৌথ পরিবারে বাবা বড় সন্তান হওয়ায় সবসময় নানা ব্যস্ততার মধ্যে থাকতেন। সেজন্য আমাদের পড়ালেখার বিষয়ে তেমন খেয়াল রাখতে পারতেন না। সব বিষয়ে সরাসরি মা দেখাশোনা করেছেন। পড়াশোনার পেছনে উনার অনুপ্রেরণাই ছিল বেশি।
তিনি বলেন, মা পরিবারের বড় বউ ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় সকাল থেকে পরিবারের সব কাজ করে আবার বিদ্যালয়ে গিয়ে সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আমাদেরও পুরো সময় দিতেন। তিনি রান্না করতে গেলেও আমাদের জোরে পড়ার জন্য বলতেন। পড়ার সময় আমাদের কোনো উচ্চারণে ভুল হলেও মা রান্নাঘর থেকে শুদ্ধ করে দিতেন। ছোট বয়সে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় আমাদেরও নিয়ে যেতেন। সেখানে ক্লান্ত হয়ে গেলে টেবিলের উপর তিন ভাইবোনকে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে আবার পড়ার টেবিলে বসাতেন।
মায়ের সঙ্গে স্মৃতি চারণ করে সুব্রত নাথ আরও বলেন, ছোটবেলায় কখনো অন্য কারো সঙ্গে দুষ্টামি বা মারামারি করে বাড়ি ফিরলে মা প্রথমে আমাকেই শাসন করতেন। কখনোই বলেনি ওই ছেলের দোষ। সবসময় বলতেন তোর দোষ। মায়ের তখনকার এই বিষয়টি আমাকে বড় হতে অনেক সাহায্য করেছে। এটির কারণেই মূলত মানুষের মত মানুষ হতে পেরেছি।
তাদের বয়োবৃদ্ধ বাবা মানিক লাল নাথ বলেন, পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সেদিকে হাল ধরতে গিয়ে ঠিকভাবে সন্তানদের সময় দেওয়া হয়নি। সংসার সামলে তিন সন্তানকে তাদের মা সরাসরি দেখাশোনা করে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। ৮২ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত আমি। এখন আমাকেও তাদের মা দেখাশোনা করছে।
ফেনীর জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী আসাদুজ্জামান দারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহরতলির একটি গ্রাম থেকে তিন সন্তানকে নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা অনেক চ্যালেঞ্জিং বিষয়। যা তাদের মায়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানের কারণে সম্ভব হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কাছ থেকে এই সফলতা দেখেছি। বর্তমান সমাজে এমন নজির অনুকরণীয়।
তারেক চৌধুরী/আরকে