বেদেনা আক্তারের স্বামী চাঁন মিয়া মারা গেছেন আট বছর হলো। নাবালক দুই ছেলের দায়িত্ব বেদেনার ওপর রেখে তিনি পাড়ি জমান পরপারে। ছোট দুই সন্তান নিয়ে বেদেনা পড়ে যান অথৈই সাগর। মারা যাবার পর স্বামীর কাফনের কাপড় কেনার টাকাও ছিল না বেদেনার। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সহযোগিতায় স্বামীর দাফন সম্পন্ন হলেও শুরু হয় নতুন কষ্টের যাত্রা।

অর্থের অভাব কী তখন থেকে বুঝতে শেখেন বেদেনা আক্তার। খেয়ে না খেয়ে ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। দু’বেলা দু-মুঠো ভাতের জন্য অবুঝ শিশু দুটো তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে। উপায় না দেখে শুরু করেন দিনমুজুরের কাজ। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে নানা রকম কাজ করে তার বিনিময়ে চাল, ধান, টাকা যে যা দিয়েছে, তাই নিয়ে সংসার চালাতে শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে চলতে থাকে তার জীবন। এভাবে কিছুদিন চলার পর সরকারের “কাবিখা” প্রকল্পে শুরু করেন মাটি কাটার কাজ। গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ ও কাবিখা’র উপার্জনেই চলে তাদের তিনজনের সংসার। 

বেদেনা আক্তারের বসবাস নেত্রকোণা সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের কারলি গ্রামে। দুই ছেলে নিয়ে এখন কোনোমতে দিন যাপন করছেন। বর্তমানে বড় ছেলে রাব্বির বয়স ১৭ বছর এবং ছোট ছেলে সাব্বিরের বয়স ১৩ বছর। তাদের বড় এক বোন ছিল নাম রুমা আক্তার, তার বিয়ে হয়েছে বাবা চাঁন মিয়া বেঁচে থাকা অবস্থাতেই। বড় ছেলে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছোট ছেলে সাব্বির অভাবের তাড়নায় যোগ দিয়েছে শ্রমজীবীদের দলে। মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে সংসার চালাতে সহযোগিতা করার জন্য।

সরেজমিনে বেদেনার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে বলেন, “গরিবের পায়ে লক্ষ্মী ভাই। এক বাড়িতে ধান রোইদে দিয়া আইছি, আরেক বাড়িতে ধান মাড়াই হইবো ওইনে কাম আছে। কাম না করলে তো আমরার খাওন নাই।”

তিনি বলছিলেন, আমার কপালে খালি দুঃখ লেখা আছে মনে হয়। আমার জামাই কাজের কারণে থাকতো অন্য জায়গায়। বাড়িতে যা টাকা পাঠাইতো তা দিয়া কোনো রকমে বাচ্চাগুলারে বুকে নিয়া দিন পার কইরা দিছি। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারলাম আমার স্বামী ওখানে আরেকটা মেয়েরে বিয়া করছে। শুইনা আফসোস ছাড়া কিছু করার আছিল না আমার। সব মাইনা নিয়া মুখ বুইজা সহ্য কইরা গেছি। তবুও আমার কপালে সুখ নাই! হঠাৎ কইরা জামাইডা আমার মইরা গেল। সুস্থ মানুষটা বাড়িতে আইলো। বুকে কেমন জানি লাগতাছে বইলা ধরফর কইরা মানষটা মইরা গেল। একটু যে চিকিৎসা করমু তারও সুযোগ পাইলাম না।

তিনি আরও বলেন, যখন উনি মারা গেল তখন আমার হাতে টাকা ছিল না। দাফন-কাফন করার মত টাকাও ছিল না আমার। তখন সবাই মিলে ক্যামনে কী করছে আমি জানি না। কয়দিন তো এমনেই গেলো। এরপরে শুরু হইলো আসল কষ্ট। বাবা ছাড়া পোলাপান নিয়া চলা যে কী কষ্টের এইডা তখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পালাম। সব চিন্তা বাদ দিয়া তখন পেটের চিন্তা শুরু করলাম। গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে যার যে কাজে প্রয়োজন তাই করতে শুরু করলাম। গ্রামের লোকজনও কাজ দিয়া আমারে অনেক সহযোগিতা করছে। এতো অভাবে দিন গেছে যে, ছেলেরা যদি দুইটা টাকা চাইতো দিতে পারতাম না। বুঝায়া বলতাম যে, তোদের তো বাবা নাই, আমি তো চাইলেও তোদের কিছু দিতে পানি না। ওরা অনেক সময় মেনে নিত, আবার অনেক সময় কান্নাকাটি করতো। তখন আমি নিজে লুকিয়ে কান্নাকাটি করতাম। আবার আমার শাশুড়িও এক বছর ধরে অসুস্থ। আমরা তো খাইতেই পাই না উনার চিকিৎসা করাই ক্যামনে? ইউনিয়ন পরিষদ থেতে বিধবা ভাতা হিসেবে তিন মাস অন্তর অন্তর ১৬০০ টাকা পান বলে তিনি জানান।

বেদেনার প্রতিবেশী আবুল কাশেম বলেন, তার স্বামী যখন মারা যায়, তখন তার বাচ্চাগুলো ছোট ছোট। তার জীবনটা আসলেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছেলেটা অবুঝ, কিছু একটা আবদার করলে তার মা দিতে না পারলে মায়ের সঙ্গে খুব রাগারাগি করে। আমরা চেষ্টা করি আমাদের জায়গা থেকে যদি কোনোভাবে সহযোগিতা করা যায়। তারা বাজার থেকে কোনো একটা জিনিস আনতে দিলে কিছু টাকা বেশি লাগলেও সেটা নিয়ে এসে তাদের দেই। কারো কাছে কিছু বলেও না। তাদের আর্থিক অবস্থাটা বলার মতো না। তাদের ঘরটা পড়ে যাইতেছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম ঠিক করো না কেন। বলল বাঁশ কেনার টাকা নেই। এখন বুঝেন তাদের অবস্থা। 

আরেক প্রতিবেশী আনোয়ারা খাতুন বলেন, দুইটা বাচ্চা লইয়া খুব কষ্ট করে চলতাছে। জামাই নাই এখন কামাই করে দেয় কেলা? বাধ্য হইয়া সে রাস্তায় মাটি কাটছে, আরেক জনের গরু পালন কইরা দিয়ে, বাড়ি বাড়ি কাজ কইরা দেয়। ছোট ছেলেটা পড়ালেখা করতো, এখন দুজনের পড়ালেখা করাইতে পারে না দেখে ছোট ছেলেটা পড়াশোনা বাদ দিছে। এখন দিন মুজুরের কাজ করে।  চতুর্দিকে সে বাইর পাতছে, কিন্তু কোনো বাইরে মাছ ঢুকে না।

১০নং রৌহা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. আবদুল মোতালেব বলেন, বেদেনার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সহযোগিতা আসলে আমরা তাদের দেওয়ার চেষ্টা করি। জামাই মারা যাওয়ার পরে উনি বাচ্চাগুলারে নিয়ে খুব কষ্টে আছেন। তাদের তেমন কোনো সহায়-সম্পদ নাই। মানুষের বাড়িতে কাজকর্ম করে তাদের খুব কষ্টের দিন যায়। পাশাপাশি ছোট ছেলেটা দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে তার মাকে একটু সহযোগিতা করে। আমার জানামতে পরিবারটি সত্যিই খুব অভাবের মধ্যে দিন পার করছে, যা বলার মতো না। আমি চেষ্টা করব সরকারি কোনো সহযোগিতা যদি আসে তাহলে তারা যেন সেটা পায়।

আরকে