নওগাঁর সীমান্তবর্তী উপজেলা ধামইরহাট। এ উপজেলায় ভারতের কোলঘেঁষে রয়েছে আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান। ৬৫২ দশমিক ৩৭ একর আয়তনের এই উদ্যান ২০১১ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকেই বহুমুখী সংকটের মধ্যে রয়েছে জাতীয় এই উদ্যান। 

প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে এই উদ্যান ধ্বংসে মেতেছে বন বিভাগ। বর্তমানে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘আলতাদিঘী পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বন বিভাগ।

এই প্রকল্পের উন্নয়নের গল্প সামনে এনেই নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে আলতাদিঘী শালবনের সহস্রাধিক গাছ। আলোচনা কিংবা সমালোচনার শুরু এখান থেকেই। সংস্কার ও উন্নয়নের নামে এসব গাছ কেটে ফেলায় ছাঁয়াঘেরা সবুজ এলাকা এখন মরুভূমির আকার ধারণ করেছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে পশু-পাখি। দিঘীর পানি শুকিয়ে ফেলায় ধ্বংস হয়েছে জলজ বাস্তুসংস্থানও। যার প্রভাবে চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জাতীয় এই শালবন। বন বিভাগের খামখেয়ালি এসব আচরণে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।

তবে বন বিভাগের দাবি, জীববৈচিত্র ধ্বংস করে নয়। বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন এবং ইকো ট্যুরিজমের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। 

ধামইরহাট পাইকবান্দা রেঞ্জের বনবিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঐতিহাসিক আলতাদিঘী সংস্কারের সময় পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন ১ হাজার ২টি সাধারণ গাছ কাটা হয়েছে। এখানে কোনো শাল গাছ ছিল না। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই দীঘির জলাশয়ের চারপাশে ২ মিটার প্রস্থ ইটের সোলিং করে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দীঘির ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত ও বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে খনন ও সংস্কার না করার কারণে দীঘিটির গভীরতা কমে যাওয়ায় ১ ফুট উচ্চতার নিচে পানি থাকতো। পাশাপাশি পাড়গুলো ভেঙে যাওয়ায় দীঘিটি পুনঃখনন ও পাড় সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই দিঘী পুনঃখননের মাটি দিয়ে নিচু স্থান ও দিঘীর পাড় সংস্কারে ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিসহ ১ হাজার ২টি গাছ কাটা হয়। এই গাছগুলো নিয়ম মেনে টেন্ডারের মাধ্যমে ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। গাছ কেটে ফেলায় পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে ৩ হাজার শোভাবর্ধক চারা রোপণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।  ঐতিহ্যবাহী এই দিঘী আবারো সবুজে পরিণত হবে।

পাড়সহ জেলার বৃহত্তর এই আলতাদিঘীটির আয়তন ৫৫ দশমিক ৪৬ একর। যেখানে দিঘীটির দৈর্ঘ্য ১.২০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ০.২০ কিলোমিটার। দিঘীটির পাড়ের আয়তন ১২ দশমিক ৬৪ একর। 

সম্প্রতি সরেজমিন আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘আলতাদিঘী পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ সমাপ্তির পথে রয়েছে। এছাড়াও সেখানে জিওবির অর্থায়নে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৩ টাকায় আরও ৫টি প্যাকেজের বনের মাঝে কংক্রিটের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এর বাহিরেও শালবন উজাড় করে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা দেখা গেছে আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানজুড়ে। কাটা হয়েছে হাজার হাজার মূল্যবান গাছ।

দিঘী সংস্কারের মাটি শুধুমাত্র পাড় ভরাটে ব্যবহার করার কথা থাকলেও তা ব্যবহার করা হয়েছে বনের বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে অবৈধভাবে কেটে ফেলা গাছের গোড়া ঢাকতে। অবাধে যত্রতত্র মাটি ভরাট করায় হুমকির মুখে পড়েছে শালবন। এছাড়াও বনের ভেতরে মাঝে মধ্যেই আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। শালবন পোড়ানোর পর এসব জায়গা ফাঁকা হলেই তা দখলে মরিয়া হয়ে উঠে একটি সক্রিয় চক্র। এতে বিলুপ্ত হচ্ছে বনের সৌন্দর্য এবং বন্যপ্রাণী। যার প্রভাবে ঐতিহাসিক আলতাদিঘী জৌলুস হারিয়ে এখন পরিণত হয়েছে গো-চারণভূমিতে।

বগুড়ার মাটিডালি থেকে আলতাদিঘী ঘুরতে আসা পর্যটক খোরশেদ হোসেন বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে প্রতি বছর নওগাঁর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবারও অসহনীয় তাপমাত্রার সম্মুখীন হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। সেই জায়গা থেকে বন বিভাগের উচিত ছিল বেশি বেশি বনায়ন করা। কিন্তু এখানে আসার পর আমরা দেখলাম উল্টো পদক্ষেপ নিয়েছে বন বিভাগ। প্রাকৃতিক বন উজাড় করে লুটপাটের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেই আলতাদিঘীতে এক সময় এলে প্রাণ জুড়াতো তা এখন গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। আসলে এই লুটপাটের প্রকল্প নেওয়ার তো কোনো দরকার ছিল না। এখানে যা ছিল সেটাই ভালো ছিল।

সাপাহার উপজেলার তিলনা গ্রাম থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক মনিরুল ইসলাম বলেন, বন্ধুদের কাছে জেনেছিলাম আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে। তাই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছিলাম। এসে হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংস করে এখানে সুসজ্জিত কৃত্তিম বনভূমি তৈরি করছে বন বিভাগ। এটা আসলেই হাস্যকর বিষয়। কারণ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কখনোই সুন্দর কিছু করা যায় না।

ধামইরহাট উপজেলার জয়জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা রিফাতুল হাসান বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে প্রাকৃতিক শালবন লুটপাট করে খাচ্ছে বনখেকোরা। এর পেছনে বন বিভাগের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও জড়িত। যার চিহ্ন বনের ভেতরে ঢুকলে স্পষ্টভাবে বেশ কিছু কিছু এলাকায় দেখা যায়। বনের কয়েক হাজার মূল্যবান শাল গাছ লুট করা হয়েছে।

আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানের এমন দশা আগামীতে পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর কীরূপ প্রভাব ফেলতে পারে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনোজ কুমার ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে আলতাদিঘী শালবন নির্বিচারে উজাড় করা কখনোই কাম্য ছিল না। কারণ স্বাভাবিকভাবে গাছগুলো যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতো, তা আর আর হবে না। বন বিভাগ হয়তো এখন সেখানে নতুন করে কিছু গাছ লাগাবে। তবে নতুন গাছ আগের পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে। এর ভয়ানক ফল ভোগ করবে ওই অঞ্চলের মানুষ।

তিনি আরও বলেন, যেকোনো প্রাকৃতিক বনায়নকে ধ্বংস করে কৃত্তিম বনায়ন করাটা পরিবেশের টেকসই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো বিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে সেখানাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর কীরূপ প্রভাব পড়তে পারে তা অবশ্যই বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল। আমি জানি না তারা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন কি-না। যদি করে থাকেন তবে তা প্রকাশ করা উচিত। কারণ এই ধরনের একটা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এতো গাছ কাটার দরকার ছিল বলে আমার মনে হয় না।

আরএআর