রংপুরের ঐতিহ্য শ্যামাসুন্দরী খাল। ১৩৪ বছর আগে পুনঃখনন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল জলাবদ্ধতা দূর ও ম্যালেরিয়া থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করা। বর্তমানে শ্যামাসুন্দরী খালে ঠিক উল্টো কাজ হচ্ছে। আবর্জনার ভাগারে পরিণত শ্যামাসুন্দরী এখন মশার উৎপাদনকেন্দ্র। সঙ্গে বর্ষা মৌসুমে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতায় প্রতি বছর নগরবাসীকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। সেই শ্যামাসুন্দরীকে মরণ দশা থেকে পুনরুজ্জীবিত করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জনসচেতনতামূলক অভিযান শুরু করেছে রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক)।

শনিবার (১১ মে) সকালে শেখ রাসেল স্টেডিয়াম মাঠে শ্যামাসুন্দরী খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণ ও জনসচেতনতা কার্যক্রমের উদ্বোধন ও শপথ পাঠ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রংপুর নগরীর বুক চিরে বয়ে যাওয়া ১৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এ খালের ৫ কিলোমিটারে একযোগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কার্যক্রম শুরু হয়। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ‘বিডি ক্লিন’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করে সিটি মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, পরিচ্ছন্নতার সুফল সম্পর্কে নগরবাসীকে বেশি করে সচেতন করতে সবাইকে কাজ করতে হবে। শ্যামাসুন্দরী খালের আশপাশে বসবাসরত সবাইকে সচেতন হতে হবে। খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের পর নতুন করে ময়লা ফেলা এবং পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য অবৈধ স্যুয়ারেজ সংযোগ প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম চলমান থাকবে। প্রয়োজনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনাসহ অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
তিনি আরও বলেন, আমার নির্বাচনী ইশতেহারে গ্রিন সিটি এবং ক্লিন সিটি ছিল অন্যতম এজেন্ডা। এরই ধারাবাহিকতায় শ্যামাসুন্দরী খালের পাঁচ কিলোমিটার (চেকপোস্ট থেকে শাপলা চত্বর) ময়লাযুক্ত মাটি পুনঃখনন ও অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শ্যামাসুন্দরী খালকে পুনরুজ্জীবিত এবং সৌন্দর্যবর্ধনের যে প্রয়াস চলছে তার সফলতা এবং রংপুরের সকল নাগরিকের সহযোগিতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই খালকে দখল-দূষণমুক্ত দৃষ্টিনন্দন খালে পরিণত করতে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি নগরবাসীকে সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে ভূমিকা রাখতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি শ্যামাসুন্দরী খাল রক্ষায় সংস্কারসহ আধুনিকায়নে প্রজেক্টের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেন তাহলে এটি সবচেয়ে সুন্দর লেকে পরিণত করা সম্ভব হবে।

এ সময় আগামী তিন মাসের মধ্যে শ্যামাসুন্দরী খাল খনন ও সংস্কারসহ আধুনিকায়নে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজেক্ট ডিজাইন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণের জন্য চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. জাকির হোসেন বলেন, আমাদের চার পাশে এখন খেকোদের সংখ্যা বাড়ছে। নদীখেকো, খালখেকো, বালুখেকো, কৃষিজমি খেকোর ছড়াছড়ি। এসব খেকোদের কারণে আমাদের পরিবেশ প্রকৃতি আজ হুমকিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খেকোরা জড়িত। তাদের কাছ থেকে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ রক্ষায় আগে নিজেদের সচেতন হতে হবে। দখলকারী, দূষণকারী, খেকোদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি শ্যামাসুন্দরী খালকে একটি আধুনিক সুবিধা সম্বলিত লেক পার্কে পরিণত করা সম্ভব। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে নগরীর মানুষজন স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ফিরে পাবে। এই খালের লেক ধরে চলাফেরার পাশাপাশি মনোরম পরিবেশ উপভোগ করা যাবে। এর জন্য শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচিয়ে রাখাটা জরুরি। যদি যত্রতত্রভাবে ময়লা-আবর্জনায় এ খালটি ভরাট করা হয় তাহলে শুধু দূষণ বাড়বে না, বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতেও পড়বে। তাই আমাদের সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এই খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কাজ করতে হবে। এই নগরীর মানুষ হিসেবে এটা সবার নাগরিক দায়িত্ব।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতিমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান,  রংপুর রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি এসএম রশিদুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহনাজ বেগম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম, বিডি ক্লিনের সমন্বয়ক জহুরুল ইসলাম রনি প্রমুখ।

কার্যক্রমের উদ্বোধন শেষে দূষণমুক্ত সবুজ পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শপথ নেন স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন বিডি ক্লিনের সদস্যরা। পরে শ্যামাসুন্দরী খালের পাঁচ কিলোমিটার পুনরুজ্জীবন ও সচল রাখতে একযোগে ১৫ পয়েন্টে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হয়। বিডি ক্লিনের স্বেচ্ছাসেবীরা নগরীর চেকপোস্ট এলাকা থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত শ্যামাসুন্দরী খালের ময়লা পানিতে নেমে আবর্জনা পরিষ্কার করতে থাকেন। এতে খালে পানির প্রবাহ হবে বলে তাদের আশা। বিডি ক্লিনের পাশাপাশি এই কার্যক্রমে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও অংশ নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ১৮৯০ সালে পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকি বল্লভ সেন তার মা শ্যামাসুন্দরীর স্মরণে এই খাল খনন করেছিলেন। খালটি রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে ১৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। এলাকাভেদে এর প্রস্থ ২৩ থেকে ৯০ ফুট। খালটি উত্তর-পশ্চিমে কেল্লাবন্দ ঘাঘট নদী থেকে শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকার বুক চিরে মাহিগঞ্জ সাতমাথা রেলগেট এলাকায় কেডি ক্যানেল স্পর্শ করে মিশেছে খোকসা ঘাঘট নদীতে।

রংপুর সিটি কর্পোরেশন ও বিভাগ হওয়ার পর শ্যামাসুন্দরী খাল ঘেঁষে খালের জায়গা দখল করে তৈরি হয়েছে বড় বড় অট্টলিকা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রেস্টুরেন্ট ও ঘরবাড়ি। এসবের প্রতিদিনের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী খালে। এ ছাড়া পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ এ খালে দেওয়ায় পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। শ্যামাসুন্দরী খালের পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নদী বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন, সভা-সমাবেশ হলেও খালের উন্নয়ন হয়নি। অবশেষে রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমানের উদ্যোগে একযোগে এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হলো। তবে নগরবাসীর দাবি পুরো খালটি যেন বর্ষা মৌসুমের আগেই পরিষ্কার করা হয়।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর