মেহেরপুরে দীর্ঘদিনের খরা আর দাবদাহের কারণে অনেক দেরিতে পাকতে শুরু করেছে লিচু। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় এ বছর লিচুর শাঁস ও স্বাদ কম। লিচু পাকতেও সময় লাগছে বেশি। তবুও লাভের আশায় অপরিপক্ব লিচু বিক্রি শুরু করেছেন ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকরা।

ক্রেতারা বলেছেন অন্য বছরের তুলনায় লিচুর শাঁস কম এবং আকারে ছোট হলেও দাম অনেক বেশি। বাগান মালিকদের দাবি, তীব্র দাবদাহে লিচু ঝরে যাচ্ছে, তাই বাধ্য হয়ে পরিপক্ব হওয়ার আগেই লিচু বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। ফলে লিচুর আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভোক্তারা। আর কৃষি বিভাগ বলছে লিচুর গুণগতমান ঠিক রাখার জন্য আরও কয়েক সপ্তাহ পর লিচু সংগ্রহের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বাগান মালিকদের।

মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় ৮০০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। শুরুতে ৬০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছিল। এসব বাগানে আঁটি লিচু, মোজাফ্ফর বোম্বাই, চিলি বোম্বাই, আতা বোম্বাই ও চায়না-থ্রি জাতের লিচু উৎপাদন হয়ে থাকে। লাভজনক হওয়ায় এ জেলায় লিচুর আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেহেরপুরের লিচু রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে।

লিচু বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে একটু দেরি করেই গাছে মুকুল এসেছিল তাও অনেক কম। উপরন্তু প্রচণ্ড দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে গাছ থেকে ঝরে গেছে অনেক লিচু। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।

কৃষকরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণেই পরিপক্ব হওয়ার আগেই গাছ থেকে লিচু পেড়ে ফেলতে হচ্ছে। কারণ গাছ থেকে লিচু ঝরে পড়ছে। গাছে লিচু ফেটে যাচ্ছে।

মেহেরপুর শহর ও গাংনী বাজারে লিচু বিক্রেতারা রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে লিচুর বাজার বসিয়ে লিচু বিক্রি করছেন। লিচু বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম ও রমজান আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, লিচুর মুকুল আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা পাইকারি দরে বাগান কিনে রেখেছিলেন। অতিরিক্ত রোদের তাপ আর অনাবৃষ্টির কারণে এবার লিচুর কালার হয়নি। শাঁস এবং স্বাদও কম। তাছাড়া লিচুর বোঁটা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে এবং লিচুর খোসা ফেটে নষ্ট হচ্ছে। যে কারণে অপরিপক্ব হলেও বিক্রি করতে হবে। তা না হলে তাদের মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান গুনতে হবে। তারা ৮০টি লিচু অর্থাৎ এক পন লিচু বিক্রি করছেন ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। লিচুর ভরা মৌসুমে এমন দাম পাওয়া যায় না তাই এসময়ের মধ্যে লিচু বিক্রি করে লোকসান পুষিয়ে নিতে হবে।

লিচু ব্যবসায়ী হুসাইন ও মহিবুল বলেন, প্রতি পন হিসেবে লিচু বিক্রি করছি ২৮০ টাকা দরে। লিচুর রং না হলেও পেকে গছে। এর চেয়ে বেশি পাকাতে গেলে আমরা পথে বসে যাব। লিচুর গুটি দেখেই সব টাকা পরিশোধ করে বাগান কিনতে হয়েছে।

লিচু ক্রেতা জুলফিকার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে নতুন ফল এসেছে। তাই বাড়ির ছেলে-মেয়েদের বায়না মেটাতে কিনতে হচ্ছে। যদিও একটু স্বাদ কম। আরও কিছুদিন গাছে থাকলে লিচু পুষ্ট হত, স্বাদও পাওয়া যেত।

আরেক ক্রেতা এনজিওকর্মী মমতাজ বেগম বলেন, সারাদিন রোদে কাজ করি। অন্যান্য ফলের তুলনায় লিচু ফলটি খেতে ভালো লাগে। তাছাড়া নতুন বছরের নতুন ফল। তাই পরিবারের জন্যও কিনতে হয়।

ক্রেতা আমেনা খাতুন বলেন, বাজারে প্রকারভেদে লিচুর দাম এবার অনেক বেশি। প্রতি ১০০ লিচুর দাম হাঁকা হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। আরও বেশি নেওয়ার ইচ্ছে ছিল তবে টক ও তুলনামূলক আঁটির আকার বড়, রয়েছে পোকার আক্রমণও তাই বেশি কেনা হয়নি।

লিচু চাষি ঝাউবাড়িয়া গ্রামের শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, তার বাগানে শতাধিক লিচু গাছ থাকলেও ফল এসেছে অর্ধেক গাছে। আবার গত বছরের তুলনায় সেই গাছগুলোতে লিচু দাঁড়িয়েছে কম। আর রৌদ্রের তাপে গাছ থেকে লিচু একাই ঝরে পড়ছে। গাছের গোড়াই পানি দিয়েও তেমন একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যেগুলো গাছে আছে, তা আবার আকারে ছোট। যার কারণে এবার বাগানে যা লিচু পাওয়া যাবে তা তিন ভাগের এক ভাগ।

পুষ্টিবিদ তরিকুল ইসলাম বলেন, সাধারণত কাঁচা বা আধা পাকা অর্থাৎ পাকা নয়, এমন লিচুতে পাওয়া যায় অ্যামিনো অ্যাসিড যা মারাত্মক বমি বমি ভাব সৃষ্টি করে। অন্যদিকে মিথাইলিন-সাইক্লো-প্রোপাইল-গ্নাইসিন উপাদান গ্রহণের ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ দ্রুত কমে যায়। এর কারণে বমি, অচেতন এবং দুর্বল হয়ে পড়ে রোগী। কাঁচা বা আধা পাকা লিচু খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সচেতনতাও বাড়াতে হবে।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার জানান, লিচুর গুণগত মান ধরে রাখার জন্য আরও কয়েক দিন পর লিচু বাজারজাত করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের। শিলাবৃষ্টি এবং ঝড় ছাড়া বর্তমানে যে আবহাওয়া বিরাজ করছে তা লিচুর জন্য উপযোগী। অপরিপক্ব লিচু খেলে ভোক্তারা লিচুর পুষ্টিমান পাবে না। লিচুর স্বাদ থেকেও বঞ্চিত হবে।

আকতারুজ্জামান/এমজেইউ