‘মাঠে কাজ করার সময় আমাদের গ্রামের অনেকেই বজ্রপাতে মারা যেত’
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে ২০০৮ সাল থেকে নিজ অর্থায়নে ২ লাখ ৮৮ হাজার তাল গাছের চারা রোপণ করেছেন চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় একজন ক্ষুদ্র কাঠ ব্যবসায়ী। শুধু তাল গাছ নয়, প্রায় ৩৫ হাজার খেজুর গাছের চারাও রোপণ করেছেন তিনি। তার এমন কর্মকাণ্ডে শুরুতে এলাকার মানুষ পাগল বললেও বর্তমানে তিনি একজন বৃক্ষপ্রেমী পরিচয়ে গোটা যশোরবাসীর প্রশংসায় ভাসছেন।
বৃক্ষপ্রেমী চিত্তরঞ্জন দাস ঢাকা পোস্টকে জানান, মরা কাঠের ব্যবসা করতে করতে ২০০৮ সালে নিজ উদ্যোগে শুরু করেন তাল গাছের চারা রোপণ কার্যক্রম। আমেরিকান এক গবেষকের তাল গাছ সম্পর্কে গবেষণার সংবাদ দেখে তিনি এই বৃক্ষপ্রেমী কার্যক্রমে নেমে পড়েন। প্রতিবছর জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তাল গাছের চারা রোপণ করেন তিনি। আর বছরের বাকি সময়টা ব্যস্ত থাকেন পরিচর্যার কাজে। চিত্তরঞ্জন দাস'র এ কাজে পাঁচ বছর ধরে সহোযোগিতা করছে তার নাতি (ছেলের ছেলে) অর্পণ দাস। সে ধোপাদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুল শেষে দাদাকে তাল গাছের চারা রোপণে সাহায্য করে সে।
বিজ্ঞাপন
সাইকেলে চড়ে বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে চিত্তরঞ্জন দাসকে তালের বীজ সংগ্রহ করতে হয়। প্রতি এক হাজার বীজ কিনতে খরচ হয় প্রায় দুই হাজার টাকা। এবং বহন খরচ দিয়ে বীজ রোপণ পর্যন্ত খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।
অপরদিকে, খেজুর গাছের চারা লাগাতে প্রতি বীজে খরচ হয় এক টাকা। বিগত ১৬ বছরে তিনি এই বৃক্ষ রোপণের পেছনে ব্যয় করেছেন প্রায় আনুমানিক ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। অভয়নগরের সরখোলা, ধোপাদী, বৈকারা, ডুমুরতলা, হাটগাছা, মশিয়াটি, বাইড়েদা, সুন্দলী, বিহারকুল, গোবিন্দপুর গ্রামসহ আশপাশের আরও কয়েকটি উপজেলায় বিভিন্ন সড়কের পাশে এ তাল গাছের চারা রোপণ করেছেন চিত্তরঞ্জন দাস।
সরখোলা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ সুমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিত্তরঞ্জন কাকা দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার দুই পাশে তাল গাছের চারা রোপণ করেন। নিজের বাড়ির অবস্থা বা নিজের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। তবুও তার যে টাকা আয় হয় তা দিয়েই তিনি নিজের সংসার খরচ আর বাকি টাকা এই বৃক্ষ রোপণে ব্যয় করেন।
চিত্তরঞ্জন দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমেরিকান এক গবেষকের গবেষণা একদিন খবরে দেখতে পাই। সেখানে দেখি একটা তাল গাছ কয়েক লাখ প্রাণীর অক্সিজেনের জোগান দেয়। শুধু তাই নয়, পরিবেশের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখা এবং বজ্রপাত থেকেও রেহাই দেয় এই তালগাছ। আর ওই সময়ে আমাদের গ্রামে অনেকে মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যেত। সেই থেকে ২০০৮ সালে শুরু করি এই তাল গাছের চারা রোপণ।
তিনি বলেন, অনেকে অনেক রকম কথা বলে আমাকে নিয়ে। আমি কারও কথায় কান দেই না। কান দিলে হয়তো আজ এতোদূর এগোতে পারতাম না। প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছি এই তাল গাছ রোপণ করতে গিয়ে। প্রতিবছর আমার এই কার্যক্রমের পেছনে খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আমার কার্যক্রমে খুশি হয়ে জেলা প্রশাসন থেকে পুরস্কার এবং উপজেলা প্রশাসন থেকে একবার তাল গাছের বীজ উপহার পেয়েছি।
চিত্তরঞ্জন দাস তার ভবিষৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, সরকার আমাকে সহোযোগিতা করলে আমি সারাদেশে দশ লাখ তাল গাছের চারা রোপণ করে দিয়ে যাব। ইতোমধ্যে আমার কাছ থেকে অনেক জেলা থেকে অনেক বৃক্ষপ্রেমী বীজ সংগ্রহ করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা এমএম হারুণ অর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিত্তরঞ্জন দাসকে এখন সবাই বৃক্ষপ্রেমী নামে চেনে। তিনি যে নিজ উদ্যোগে তাল গাছ রোপণ করছে এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। একটা সময় হয়তে তিনি থাকবেন না, কিন্তু এই তাল গাছের সুফল আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভোগ করবে। তাল গাছ বজ্রপাত, তাপদাহসহ নানা রকম পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে।
ধোপাদী পূর্বপাড়া গ্রামের জাফর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা সময় ছিল আমাদের এই অভয়নগরে তাল গাছ তেমন দেখা যেত না। দু একটা দেখা গেলেও বিলের মধ্যে কোনো এক জায়গায়। মাঠে কাজ করতে গিয়ে অহরহ বজ্রপাতে অনেক কৃষক মারা গেছে।
তিনি বলেন, চিত্তরঞ্জন দাস বিগত ১৬ বছরে যা করেছে তা পরিবেশের জন্য অনেক বড় অবদান। প্রথমদিকে তাকে সবাই পাগল বলতো। আর এখন তাকে সবাই সম্মানের চোখে দেখে।
এ বিষয়ে পরিবেশকর্মী আশিক মাহমুদ সবুজ বলেন, চিত্তরঞ্জন দাস পরিবেশের একটা বিবেক বলা যায়। পরিবেশ যখন বিরুপ পর্যায়ে, আমরা সকলে চেষ্টা করছি জলবায়ু পরিবর্তনের তখন চিত্তরঞ্জনের মতো একজন মানুষও কাজ করছে জলবাযু পরিবর্তনের জন্য। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাল গাছ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
এ্যান্টনি দাস অপু/এমএএস