কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড
বিশাল কারখানায় নেই ফ্যান-এসি, তীব্র গরমেও স্বস্তি
সাততলা ভবন। প্রায় আট লাখ বর্গফুটের বিশাল এক কারখানা। ৪০ হাজার বর্গফুট ছড়ানো একেকটি ফ্লোর। দিনে-রাতে দুই শিফটে এখানে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। এত বড় কারখানায় একটি এসিও নেই। নেই কোনো বৈদ্যুতিক পাখা। তবুও এই গরমে ঘামছে না কেউ। চলমান অসহনীয় দাবদাহে বেশির ভাগ মানুষ অস্বস্তিতে থাকলেও এই কারখানার শ্রমিকদের নেই অস্বস্তি। বরং স্নিগ্ধ ও হিম পরিবেশে আনন্দ চিত্তে কাজ করেন সবাই। কেননা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে এই কারখানার ভেতরটা কয়েক ডিগ্রি শীতল।
অবাক করা এই কারখানাটি কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের। রংপুর মহানগরীর রবার্টসনগঞ্জ স্টেশন রোড ঘোড়াপীর মাজার সংলগ্ন সড়কের পাশে এর অবস্থান। কারখানাটির ভবন শীতল রাখা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের স্থাপত্যকৌশল প্রয়োগ করে। এতে কারখানার ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। অন্যদিকে গাছগাছালিতে ভরা নান্দনিক এই সবুজ কারখানায় মানসিক প্রশান্তিতে কাজ করেন শ্রমিকরা।
বিজ্ঞাপন
কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনে একটি সবুজ (গ্রিন) কারখানা গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য। এর নকশায় কারখানা ভবন ও মানুষের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধন স্থাপনে চেষ্টা করেছেন স্থপতি। গ্রামবাংলার লোকজ জ্ঞান প্রয়োগে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন এই সবুজ কারখানাটির স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার। এমন স্থাপত্যের জন্য তিনি এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার জিতেছেন। তিনি নকশাবিদ আর্কিটেক্টসের প্রধান স্থপতি।
যার হাত ধরে কারুপণ্য এবং শতরঞ্জির বিকাশ
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মরহুম এম এ সোবহানের ছেলে সফিকুল সেলিম। বাড়ি রংপুরের গুপ্তপাড়ায়। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। স্ত্রী সুরাফা হোসেন। বাবাকে রাজনীতি করতে দেখে ছোটবেলায় নিজেও জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। রাজনীতির দিকে অধিক মনোযোগী হওয়ায় ১৯৮০ সালে রংপুর ক্যাডেট কলেজে অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারেননি সফিকুল সেলিম। এ কারণে ঘর থেকে বিতাড়িত হন। পরে নিজ চেষ্টায় ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম হন। এ কারণে পরবর্তী ক্লাসে বিনা টাকায় ভর্তির সুযোগ পান।
কিন্তু রাজনীতি যে তার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। তাই এখানেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন পড়ালেখার প্রতি। স্কুলে ফাঁকি দেওয়ার কারণে সেখানেও আর পড়তে পারলেন না। এরপর অন্য একটি স্কুল থেকে ১৯৮২ সালে এসএসসি ও ১৯৯১ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স পাস করেন। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে ঢাকা শিল্পমেলায় একটি স্টল দিয়েছিলেন। দেশ ও বিদেশের নানান গুণীজন ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের ছবি গম গাছের খড় দিয়ে বানিয়েছিলেন। ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবিও। এরকম দেড় হাজার ছবি বানিয়ে স্টলে টানিয়ে রেখেছেন। ভেবেছিলেন অনেক বিক্রি হবে। কিন্তু কোনো ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে না পারায় খানিকটা হতাশ হয়ে পড়েন তিনি।
এরপর ক্রেতা আকৃষ্ট করার জন্য স্টলে টানিয়ে দেন- আপনি কি আপনার ছবি গমের শিষ দিয়ে বানাতে চান? এরপরই একের পর এক অর্ডার পেতে থাকেন। দিনে গড়ে ১০টি করে অর্ডার পেতেন। ছবিগুলোর বিক্রয়মূল্যও বেশ ভালো পেতেন। মেলা শেষে রংপুরে ফিরে এসে ভাবতে থাকেন হস্তশিল্প নিয়েই তিনি কিছু একটা করবেন।
১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ছাত্ররাজনীতি করে গ্রেপ্তার হন। তিন মাস থাকতে হয় রংপুর জেলে। সেখানে কয়েদিদের হস্তশিল্প বুননের কাজ বিমুগ্ধ হয়ে দেখতেন। নিজেই অনেকটা রপ্ত করে ফেলেন এই কাজ। জেল থেকে বেরিয়ে ঝুঁকে পড়েন সেই বুননের দিকে। পরিকল্পনা করেন হস্তশিল্পের একখানা কারখানা গড়ে তোলার।
দোকান থেকে বিশাল কারখানা
তৎকালীন রংপুর প্রেসক্লাবের বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার বন্ধ থাকা হস্তশিল্পের একটি দোকান ভাড়া নেন। সেখানে চালু করেন একখানা শতরঞ্জি বিপণন কেন্দ্র। হারিয়ে যাওয়া এই শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা ২০ জন কারিগরকে তিনি খুঁজে বের করেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন কারিগর তৈরি করেন। তাদের নিয়ে পুরোদমে শুরু করেন শতরঞ্জি বুননের কাজ। ১৯৯১ সালে গড়ে তোলেন কারুপণ্য নামে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি বিপণনের দোকানটি।
প্রথম দিকে দোকানের আয় ছিল সীমিত। ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী শতরঞ্জি বানানো হত কারিগরদের দিয়ে। সেগুলোই সরবরাহ করা হত। কিন্তু এত অল্প আয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার পাত্র নন সফিকুল সেলিম। তাই নেমে পড়লেন পণ্য আর দোকানের প্রচারণায়। বেশ ভালো সাড়াও পেলেন। দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় স্টল বসালেন। অর্ডার অনুযায়ী শতরঞ্জি বানিয়ে দেশের নানা জায়গায় সরবরাহও করলেন। একসময় ঢাকায় শতরঞ্জি নামের একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুললেন। অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তার ব্যবসা সম্প্রসারিত হতে থাকে।
শতরঞ্জির বাজার তৈরি করতে তিনি হন্যে হয়ে ছুটতে থাকেন। বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানান দেশে প্রচারণা চালাতে থাকেন। সর্বপ্রথম ২০০২ সালে জাপানে এই পণ্য রপ্তানির সুযোগ পান। শতরঞ্জি নিয়ে তার ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা আরও বড় হতে থাকে। রংপুর শহর থেকে চার কিলোমিটার পশ্চিমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি কারখানা ভাড়া নিয়েই শুরু করেন নিজ কারখানা। এখানকারই ৫০ জন নারী-পুরুষকে নিয়ে শতরঞ্জি বুনন শুরু করেন। রংপুরে প্রতিষ্ঠানটির নাম দেন কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড।
এ ছাড়া রয়েছে ছোটবড় আরও বেশ কয়েকটি কারখানা। এ দীর্ঘ পথচলায় প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রায় আট হাজার জনবলের বিশাল শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর এ জনবলের ৯০ শতাংশই নারী। শতরঞ্জি দিয়ে শুরু হলেও এখন কারুপণ্যের কারখানায় তৈরি হচ্ছে নানা রকমের হস্তশিল্প পণ্য। বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প রপ্তানি বাণিজ্যে শিল্পখাতে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে কারুপণ্য। সেজন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে।
বরার্টসনগঞ্জে স্থাপিত কারুপণ্যের বিশাল কারখানাটি এখন শুধু ভবনের দিকে আকৃষ্ট করে না। দেশের অর্থনীতি ও অগ্রগতিতে এই কারখানার মালিক-শ্রমিকদের ভূমিকাও ঈর্ষণীয়। বর্তমানে নানা পর্যায় পেরিয়ে রংপুরের শতরঞ্জি রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অর্ধশতাধিকেরও বেশি দেশে।
কারখানাটির বিশেষত্ব
এ কারখানা যেন সবুজের রাজত্ব। চারদিকে কেবল সবুজের সমারোহ। সবুজ বাগানে নানা প্রজাতির গাছপালা-লতাপাতা, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে আছে পরিবেশ। ইট-পাথরের দালান ছেয়ে আছে নানা প্রজাতির গাছপালা আর ফুল-ফলে। দালান বেয়ে ঝুলছে লতাপাতা। সেবা বিভাগের একতলা ভবনের ছাদেও সবুজের বাগান। এটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘নন্দিনী পার্ক’। আছে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কারুকার্যখচিত বেঞ্চ। পানির ফোয়ারা আর চোখ জুড়ানো সব ভাস্কর্য। পানির ফোয়ারার মাঝে পদ্মফুলের কি যে অপরূপ শোভা, যা চোখে পড়ার মতো! কর্মচারী-শ্রমিকদের জন্য সবুজ গাছের ছায়ায় বেঞ্চে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নেওয়ার সেই নস্টালজিক ব্যবস্থা। এখানেই দুপুরের খাবার খান শ্রমিকরা।
পুকুরের মতো জলাধার
কারখানার স্থাপত্য নকশায় এমন বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে কারখানার ভেতরে বাতাস প্রবাহিত হয়। নিচতলায় লবিতে পুকুরের মতো বড় বড় চারটি জলাধার। ১৫ হাজার বর্গফুট ব্যাসার্ধের এ জলাধারগুলো একসঙ্গে ধারণ করতে পারে ৫ লাখ লিটার পানি। এখানকার আয়রনমুক্ত এই পানি কারখানায় শতরঞ্জি ডাইংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়ে এই জলাধারে আসে। সবুজ গাছপালা আর এই পানির ওপর দিয়ে উড়ে আসা বাতাস ৩৭ ফুট ব্যাসার্ধের চারটি চক্রাকার শূন্য স্তম্ভের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কারখানার ভেতরে। তারপর বিভিন্ন তলায় উঠে যায়। ফলে এসি বা ফ্যান ছাড়াই কারখানার বাইরের চেয়ে ভেতরের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়।
ভিন্নধর্মী নকশা প্রসঙ্গে কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, এই শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় গ্রামবাংলার লোকজ জ্ঞানই প্রয়োগ করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ভিটেবাড়ির দক্ষিণ দিকটি খোলা রাখা হয় এবং সেদিকে একটি পুকুর থাকে। গরমকালে পুকুরের ওপর দিয়ে বাতাস শীতল হয়ে এসে বাড়িতে প্রবেশ করে বেরিয়ে যায়। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী গরম বাতাস ওপরে ওঠে। আর শীতল বাতাস নিচে পড়ে থাকে। এই গরম বাতাস ছাদের ওপর চিমনির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে পুরো ভবন শীতল হয়ে আসে। কারও জ্বর হলে যেমন কপালে জলপট্টি দেওয়া হয়, কারখানাটিতেও সে রকম জলপট্টি দেওয়া হয়েছে বলা চলে।
ভবন শীতল রাখার কৌশল
সাততলা কারখানা ভবটি দেখলে একটা বিশাল সবুজ বাগান বললে ভুল হবে না। নানা প্রজাতির গাছে ছেয়ে আছে ইট-পাথরের দালান। সাততলা ভবনের ওপর থেকে দেয়ালজুড়ে ঝুলছে লতাপাতার গাছ। ভবনের সামনেও গাছগাছালি। দক্ষিণের বাতাস এসে গাছে দোল খায়। এভাবে দেয়ালগুলো গাছে ছেয়ে ফেলাও ভবন শীতল রাখার কৌশলের অংশ।
কারখানার কর্মকর্তারা বলেন, ভবনের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সূর্যের আলো এসে পড়ে। সূর্যের তাপ কারখানার দেয়ালে পড়ে এর প্রভাব যেন ভেতরে না যায় এজন্য ভবনের প্রতি তলায় সাড়ে চার ফুট দূরত্বে বারান্দা ও জানালা রয়েছে। সেই সঙ্গে বাইরে দেয়ালজুড়ে লাগানো হয়েছে সবুজ লতাপাতা গাছ। এ কারণে রোদের তাপ ভেতরে ঢুকতে পারে না। এ ছাড়া কারখানার দক্ষিণে সবুজ গাছগাছালি লাগানো রয়েছে। এই গাছে এসে দক্ষিণের গরম বাতাস বাধা পায়। ঘুরপাক খেতে খেতে কারখানার দেয়ালে গিয়ে গরম হাওয়া আরও শীতল হয়ে যায়।
মেঝে ফুটো ও উচ্চতা
কারখানার কর্মকর্তারা বলেন, সাধারণত ভবনের মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ১০ ফুট হয়। কিন্তু এখানকার প্রতিটি তলার মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা রয়েছে ১২ ফুট। এতে গরম কিছুটা কম অনুভব হবে। এ ছাড়া কারখানার প্রতি তলায় মেঝের মধ্যে যন্ত্র চালানোর ফলে গরম বাতাস বের হয়, সেই বাতাসও যেন ঘরের ভেতর ঘুরপাক না খায় এজন্য মেঝের মধ্যে প্রতিটি যন্ত্রের নিচে ফুটো রয়েছে। মেঝের মধ্যে এসব ফুটো দিয়ে গরম বাতাস একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানালার ওপরের ঘুলঘুলির মধ্য দিয়ে বের হয়ে যায়।
আমাদের দেশে বছরের ৯ মাসই গরমের দাপট থাকে। বাকি তিন মাস শীতের আবহ। আর শীতকালে দক্ষিণের বাতাস তেমন একটা থাকে না। ওই সময় প্রবাহিত হয় উত্তরের ঠান্ডা বাতাস। এ সময় শীত যেন বেশি অনুভূত না হয়, এ জন্য কারখানার উত্তরে জানালা বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া কারখানার তাপমাত্রা মাপার জন্য প্রতি তলায় রয়েছে ব্যারোমিটার।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চমক, দূষণ থেকে রক্ষা
কারুপণ্যের এই কারখানায় কালো ধোয়া ও নোংরা দুর্গন্ধময় পানি বের হয় না। বের হয় না মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ। পুরো কারখানাটি কেবল সবুজে সবুজময়। এই কারখানায় ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক ও নবায়নকৃত কাঁচামাল। এর মধ্যে রয়েছে স্পিনিং মিলের তুলার বর্জ্য থেকে তৈরি সুতা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ঝুট কাপড়, পাটের আঁশ, কাশ-খড়, হোগলাপাতা, ধানের খড়, কচুরিপানা, কলাগাছের বাকল, ভুট্টার খোসা, নারকেলের ছোবড়া ইত্যাদি।
বছরে কয়েক হাজার টন কটন মিলের তুলার বর্জ্য থেকে তৈরি হয় সুতা। তা ছাড়া গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির বর্জ্য ঝুট কাপড় এবং পাটের আঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে এই কারখানায়। বর্জ্য নবায়ন করে পণ্য প্রস্তুত করার ফলে দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে কারখানাসহ আশপাশের পরিবেশ ও প্রকৃতি। শুধু তাই নয় আধুনিক যান্ত্রিক জীবনের মাঝেও এখানে রয়েছে গ্রামীণ জীবনের সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ ছোঁয়া। আর আধুনিকতার সকল সুযোগ-সুবিধা তো আছেই।
কারখানাজুড়ে একমাত্র এসি
পুরো কারখানা এসি ও বৈদ্যুতিক পাখামুক্ত করা গেলেও কারখানার পশ্চিমে একটি আলাদা তলায় অল্প কিছু জায়গাজুড়ে বসা অফিস কক্ষে এসির দেখা পাওয়া গেল। এখানে এসি কেন?
কর্মকর্তারা বলেন, এই অংশটি বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এখানে শীতলীকরণ প্রক্রিয়া কাজ করে না। তা ছাড়া বিদেশি ক্রেতারাও এলে এখানে সভা করা হয়। এ জন্য অফিস কক্ষটিতে এসির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তা ছাড়া কারখানাটি পূর্ব-পশ্চিমে ছড়ানো। প্রবেশমুখ দক্ষিণে। দুপুরের পর সূর্যের তাপ আরও প্রখর হয়। এই তাপ যেন সরাসরি কারখানার দেয়ালে না পড়ে এ জন্য পশ্চিম দিকের দেয়ালজুড়ে দোতলায় এই অফিস কক্ষটি করা হয়েছে।
সবুজময় এ কারখানায় স্বস্তিতে সবাই
এই কারখানাটি শুধু দেখতেই সুন্দর নয়। দুপুর ও রাতের খাবার, চিকিৎসা, কর্মীদের শিশুদের দেখাশোনা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার থেকে শুরু করে এখানে কর্মীদের জন্য রয়েছে নানা ধরনের সুবিধা।
শ্রমিকরা বলেন, এখানে কাজ করে অনেক ভালো লাগে। গরমে কখনো শরীর ঘামে না। আর এখানের স্যাররা খুব ভালো। আর এখানে অনেক নিরাপত্তার মাঝে থাকি। আমাদের বাড়ি যেমন এখানেও তেমন।
কারখানাটি নিয়ে কারুপণ্যের জেনারেল ম্যানেজার (ফাইন্যান্স অ্যান্ড আইটি) সিদ্ধার্থ লাহিড়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে চারদিকে পানি। কখনও গরম লাগে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটি করা হয়েছে। কারখানার পরিবেশ সব সময় শীতল থাকে। তবে এই কারখানায় সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। কারখানার স্থাপত্য নকশায় এমন এক বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। যাতে কারখানার ভেতরে বাতাস প্রবাহিত হয়।
শীতল থাকার বিষয়ে কারখানার গণসংযোগ বিভাগের উপদেষ্টা মাহবুব রহমান বলেন, কারখানাটি শ্রমিকবান্ধব। আর এখানে পরিবেশের কথা চিন্তা করেই ভবনটি এভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে। এটি করার উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকরা যখন কাজ করবে তখন তারা যাতে ক্লান্ত না হয়। আর সুন্দর পরিবেশে তারা যেন কাজ করতে পারে। পরিবেশকে ভালো রাখার জন্যই এমনভাবে কারখানাটি তৈরি করা হয়েছে।
এই বিষয়ে রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তরাঞ্চলে কারুপণ্যের মতো আরও সবুজ কারখানা গড়ে তুলতে হবে। এ ধরনের কারখানা বৃদ্ধি পেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে রংপুরসহ বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।
পরিবেশ সংগঠকরা কি বলছেন
সবুজে ঘেরা এই কারখানাটি নিয়ে গর্ব করছেন পরিবেশ সংগঠকসহ আবহাওয়াবিদরা। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। বর্তমান তাপপ্রবাহে অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন সময়ে হাজার হাজার শ্রমিকের জন্য কারুপণ্যের কারখানাটি একটি স্বস্তির জায়গা। তাপমাত্রা সহনীয় সবুজেবেষ্টিত এমন শীতল স্নিগ্ধ কারখানা সব জায়গায় গড়ে তোলা সম্ভব হলে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালো থাকবে। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ কমে আসবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) রংপুর জেলা সদস্য সচিব রশিদুস সুলতান বাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুষণমুক্ত পরিবেশ ও তাপমাত্রা ভারসাম্য রক্ষায় কারুপণ্যের কারখানাটি একটি অনন্য স্থাপনা। এই কারখানাটির সবুজায়ন বাইরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে যেমন নির্মল রাখছে তেমনি বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নির্গমনও করছে। প্রতিটি কারখানা যদি এমন পরিকল্পনায় গড়ে তোলা যেত তাহলে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ আজ অসহনীয় তাপপ্রবাহের কাছে ওষ্ঠাগত হত না।
তিনি আরও বলেন, একটা সময় রংপুর শহরে সড়কের দু’পাশে অনেক শতবর্ষী গাছগাছালি ছিল। সড়কের সৌন্দর্য বাড়ানোর সঙ্গে পরিবেশ নির্মল রাখতে গাছগুলো ছিল বেশ উপকারী। কিন্তু সময়ের বিবর্তন আর উন্নয়ন অবকাঠামোর কারণে আজ সেই গাছগুলো নেই। জনসংখ্যার চাপে দিন দিন প্রতিনিয়ত গাছ নিধন হচ্ছে। এর কারণে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে; আবহাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাছ নিধনের কারণে বৃষ্টিও হচ্ছে না। বৃষ্টির অভাবে আমাদের নিত্যজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গাছ নিধনের ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে; বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে অধিক বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় উদ্যোগী হতে হবে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ ও সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলমান তাপপ্রবাহে রংপুর বিভাগে ৩৫-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ ধরনের তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে। অসহনীয় এ তাপপ্রবাহে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করাসহ শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট অনেক বেড়েছে। অতিরিক্ত গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে কারুপণ্য কারখানাটি শ্রমিকবান্ধব ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত।
এমজেইউ