হেফাজতের তাণ্ডবে জড়িত না থেকেও মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের চালানো তাণ্ডবের এক মাস পার হয়েছে। আলোচিত সেই তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের হওয়া ৫৫ মামলায় বুধবার (২৮ এপ্রিল) সকাল পর্যন্ত ৩৮৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রতিদিনই পুলিশ গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু যাদের হেফাজতের কর্মী-সমর্থক বলে আটকের পর তাণ্ডবের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তারা হেফাজতের তাণ্ডবে জড়িত ছিলেন কি না-সেটি ভালো করে খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। যদিও পুলিশ বলছে, স্বচ্ছতার সঙ্গেই গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
তবে, হেফাজতের তাণ্ডবে অংশ না নিয়েও কয়েকজনকে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাদের কেউ কেউ এখন গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাণ্ডবের একাধিক মামলায় ফাঁসানো হবে- সেই ভয়ে কেউ আবার মুখ খুলছেন না।
বিজ্ঞাপন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের এলেম খানের ছেলে আফজাল খানকে সন্দেহজনকভাবে গত ১৩ এপ্রিল রাতে আটক করে সদর থানা পুলিশ। পরদিন ১৪ এপ্রিল তাকে ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চালানো হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অথচ ৫৯ বছর বয়সী আফজালের বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দূরত্ব ৪ কিলোমিটারেরও বেশি। তাকে হেফাজতের সমর্থক বলছে পুলিশ।
শারীরিকভাবে অসুস্থ আফজাল প্রকৃতপক্ষে এত দূরে গিয়ে তাণ্ডবে অংশ নিয়েছিলেন কি না- সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। আফজালের পরিবারের দাবি, মাস দেড়েক আগে পুলিশের এক সোর্সকে থাপ্পড় মেরেছিলেন আফজাল। এর জেরে ওই সোর্সই তাকে তাণ্ডবের মামলায় ফাঁসিয়েছেন।
আফজাল হোসেনের ছোট ভাই খলিলুল রহমান বলেন, আমাদের ইউনিয়নের আমতলি গ্রামের পুলিশের সোর্স নাজিরের সঙ্গে আমার ভাইয়ের ঝামেলা হয়েছিল। মাস দেড়েক আগে বাজারে তর্কাতর্কির জেরে নাজিরকে থাপ্পড় মারেন আমার ভাই। এরপর থেকেই শোধ নেওয়ার চেষ্টা করছিল নাজির। এর জের ধরে গত ১৩ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে পুলিশ এসে গোয়াল ঘর থেকে আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়।
পুলিশের কাছে ধরে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, সন্দেহমূলকভাবে নিয়ে যাচ্ছে, জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ১৪ এপ্রিল তাকে মামলায় চালান করে দেওয়া হয়। আমার ভাই কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না, তিনি অসুস্থ মানুষ।
আফজালের ছেলে আরিফ খান বলেন, বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা থানায় গিয়ে কারণ জানতে চাইলে পুলিশ জানায়, আমার বাবা হেফাজতে ইসলাম করে। কিন্তু পুলিশ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। পরে পুলিশ জানায়, যেহেতু হাজতে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে, এখন আর ছাড়া সম্ভব না।
তখন থানার এএসআই সেলিম মিয়া জানান, বাবাকে সন্দেহজনকভাবে একটি মামলায় চালান দেওয়া হবে। আমরা যেন আদালত থেকে জামিন করিয়ে নিই। কিন্তু পরে দেখি বাবাকে হেফাজতের তাণ্ডব মামলায় চালান দিয়েছে পুলিশ। আমার বাবা সারাদিন কৃষি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ। তিনি হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত নয়।
নাটাই উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. ইকবাল হোসেন বলেন, আমার জানা মতে আফজাল সেদিন হুজুরদের মিছিলে যায়নি। সে শারীরিকভাবেও অসুস্থ। সোর্সের সঙ্গে ঝামেলার বিষয়টি আমিও জানি।
জেলার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের ধামাউরা গ্রামের আলী আকবরের ছেলে তাজুল ইসলাম (৩৬) হেফাজতের তাণ্ডব মামলার আসামি হয়েছে। তাকে সরাইল থানার অরুয়াইল পুলিশ ক্যাম্পে হামলা মামলার ১১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। গত ২৭ মার্চ বিকেলে পুলিশ ক্যাম্পে হামলার ঘটনার ৩১ মার্চ সরাইল থানায় ৬৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১২০০ জনকে আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে।
তবে তাজুল ইসলাম জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে বসবাস করেন। সিলেট শহরের শিবগঞ্জে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবসা করেন তিনি। ঘটনার দিনও তিনি সিলেটে ছিলেন। অথচ তাকে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার মুঠোফোনে তাজুল ইসলাম বলেন, আমি ১৮-১৯ বছর ধরে সিলেটে বসবাস করছি। আমি শিবগঞ্জে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবসা করি। আমার পরিবার গ্রামের বাড়িতেই থাকে। ওইদিন (২৭ মার্চ) আমি সিলেটেই ছিলাম। পরে জানতে পারি পুলিশের মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। আমার ধারণা কেউ শত্রুতা করে পুলিশের কাছে আমার নাম দিয়েছে। অথচ আমি কিছুই জানি না। আমি মামলা দায়েরের ১০-১২ দিন পর বিষয়টি জানতে পেরেছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সভাপতি ডা. মো. আবু সাঈদ বলেন, অনেকের কাছে তাণ্ডবের ঘটনার ছবি-ভিডিও ফুটেজ আছে। সেগুলো ভালো করে পর্যালোচনা করে এবং তদন্ত করে যেন সঠিক আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান বলেন, কোনো অপরাধীই স্বীকার করে না সে অপরাধী। পুলিশ ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করছে। স্বচ্ছতার সঙ্গেই গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেকেই অস্বীকার করে যে ঘটনাস্থলে ছিল না, কিন্তু আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখি যে সে সেখানে ছিল। তবে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে আমাদের কাছে লিখিত দিলে, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব। যারা নিরপরাধ, তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই।
আজিজুল সঞ্চয়/এসপি