আমার ফুটফুটে ভাতিজারা লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো
আমার ছোট্ট দুইটা ভাতিজা। ওদের সঙ্গে সব সময় মজা করতাম কোলে নিতাম। আজ সকালেও ওদের কোলে নিয়েছি। অথচ ভাগ্যের কী নির্মমতা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চোখের সামনে আমার সোনার টুকরা ভাতিজা দুইটা লাশ হয়ে নিথরদেহে বাড়িতে ফিরে এলো। এই ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখার চেয়ে আমি মরে গেলেই ভালো হতো। এভাবে বলছিলেন দুই ছেলে, স্ত্রীসহ নিহত হওয়া বোয়ালমারীর মিলনের ছোট ভাই হাবিবুর রহমান।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়নের ছত্রকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার সন্তান রাকিবুল ইসলাম মিলন (৪০) ঢাকার সচিবালয়ের গণপূর্ত বিভাগের লিফটম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। ত্রাণ হিসেবে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধীনে ১ বান টিন ও ১২ হাজার টাকা নিতে তিনি ফরিদপুর আসছিলেন পিকাপে করে। ওইসব ত্রাণ সামগ্রী বাড়িতে রেখে আজই তার ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু পথে ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের তেতুলতলায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী আর দুই ছেলেসহ তিনি নিহত হন। ঢাকায় ফেরার বদলে চিরতরে গেলেন না ফেরার দেশে। এ দুর্ঘটনায় মারা যান মোট ১৪ জন।
বিজ্ঞাপন
মিলনের বড় ভাই ফরিদ মোল্লা (৫৫) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাই ঢাকায় একটি সিকিউরিটি গার্ড সরবরাহকারী থার্ড পার্টি কোম্পানির আওতায় গণপূর্ত বিভাগের লিফটম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। কয়েকদিন আগে বোয়ালমারীতে ঝড় হয়। সেই ঝড়ের জন্য টিন ও টাকা বরাদ্দ পায় মিলন। বাড়িতে এসব ত্রাণ সামগ্রী বুঝিয়ে দিয়ে আজই ঢাকায় যাওয়ার জন্য একবারেই সে পিকাপে করে ফরিদপুর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসছিল। পথিমধ্যে বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে রাকিবুলের স্ত্রী সুমি বেগম (৩৩) ও দুই সন্তান আবু রায়হান (৬) আবু সিনান রুহানসহ (৫) মারা যায়।
তিনি জানান, এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তার মা খুড়িয়া বেগম। এ দুর্ঘটনায় মর্জিনা বেগম (৭০) নামে মিলনের নানী শাশুড়িরও মৃত্যু হয়েছে। মর্জিনা বেগম একই গ্রামের ওহাব মোল্লার স্ত্রী।
মিলনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার তিন ছেলের মধ্যে রাকিবুল ইসলাম মিলন মেঝো ছিলেন। তার বড় ভাই ফরিদুল ইসলাম একজন স্কুলশিক্ষক। আর ছোট ভাই হাবিবুর রহমান মাস্টার্স পাস করে আলফাডাঙ্গা সদরে দোকান করেন। ৮ বছর আগে আলফাডাঙ্গার বানা ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের রাকায়েত মোল্লার মেয়ে সুমির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের ওই দুইটি ছেলে সন্তানই ছিল।
এ ঘটনার পর মিলনের বাড়িতে মরদেহগুলো পৌঁছার পর এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে চারপাশ। আহাজারি করে মিলনের ছোট ভাই হাবিবুর রহমান বলছিলেন, এই দুর্ঘটনায় আমার ভাইরে হারাইলাম। সোনার টুকরা দুইটা ভাতিজা হারাইলাম। কী এমন কাজ করছিলাম, আল্লাহ আমাদের এ কেমন পরীক্ষায় তুমি ফেলাইলা।
ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে হাবিবুর বলেন, আমাদের সব শেষ। আমার ভাই ভাবি চলে গেল। ভাতিজারা আর চাচা বইলা ডাকবে না। সারাজীবন এ ক্ষত চিহ্ন আমরা কীভাবে বয়ে বেড়াবো। আমরা এত যন্ত্রণা নিয়ে কি বেঁচে থাকতে পারব?
বোয়ালমারীর শেখর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওদের লাশ বাড়িতে আনার পর থেকেই আমি ওই বাড়িতে বসে আছি। কী সান্ত্বনা দেব ওদের? এই শোক কী সান্ত্বনা দেওয়ার মতো শোক? আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে বসে আছি, কীভাবে কি হয়ে গেল!
তিনি বলেন, একটি পরিবারের দুইটি সন্তানসহ ফুটফুটে সাজানো সবকিছু নিমিষেই একটা সড়ক দুর্ঘটনা সব শেষ করে দিল। আল্লাহ যেন এতো কঠিন পরীক্ষায় কোনো পরিবারকে না ফেলেন।
জহির হোসেন/এমএএস