রহিমার টানে আমেরিকার ক্রিস্ট মার্ক এখন যশোরে
যশোরের মেয়ে রহিমার প্রেমের টানে আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্ট মার্ক হোগল এখন বাংলাদেশে। স্ত্রী-সন্তানসহ সুখে শান্তিতে তারা ১ যুগ ধরে বসবাস করছেন। ভালোবাসার জন্য বাঙালি সংস্কৃতি মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। চাকরি ছেড়ে এখন ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকাজ করছেন এ দেশে।
স্বামী-স্ত্রী মিলে নিজেদের জমিতে ধান লাগানো, কাটাসহ সংসারের সব কাজই করছেন একসঙ্গে। ক্রিস্ট মার্ক-রহিমা দম্পতিকে দেখতে ও ছবি তুলতে অনেকেই ভিড় করছেন তার বাড়িতে। আর প্রতিবেশীরাও সন্তুষ্ট ক্রিস্ট মার্ক হোগলের ব্যবহারে।
যশোরের কেশবপুর উপজেলার মেহেরপুর গ্রামের মৃত আবুল খার মেয়ে রহিমা খাতুন। শৈশবে বাবা-মার হাত ধরে অভাবের তাড়নায় পাড়ি জমান ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। বাবা শ্রম বিক্রি করতেন। ১৩ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। একে একে তার কোলজুড়ে আসে তিনটি সন্তান।
বিজ্ঞাপন
সংসারে অভাব-অনটনের কারণে তার প্রাক্তন স্বামী গ্রামের জমি বিক্রি করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বাধ্য হয়ে জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই শহরে যান রহিমা। জীবিকার তাগিদে মুম্বাই শহরে থাকাকালীন হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় ক্রিস্ট মার্ক হোগলের সঙ্গে রহিমার পরিচয় হয়। প্রথম দেখাতেই রহিমাকে ভালো লেগে যায় তার।
হিন্দিতে দু-এক লাইন কথা বলার পর তারা আবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই ভালোলাগাটা আস্তে আস্তে ভালোবাসাতে রূপ নেয়। ছয় মাস প্রেমের পর তারা বিয়ে করেন।
পরে তারা কেশবপুরের মেহেরপুর রহিমার বাবার ভিটায় ফিরে আসেন। মেহেরপুরে বাড়ির কাজ শেষ হলে আমেরিকা থেকে মা ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসবেন এখানে।
মেহেরপুর গ্রামের কপোতাক্ষ নদের তীরে রহিমা আর ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্ট মার্ক হোগলের নবনির্মিত ৪ তলা বাড়িতে বসে তাদের ১ যুগেও বেশি সময় ধরে প্রেমকাহিনী স্মৃতিচারণ করে রহিমা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্রিস্ট মার্কের বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। তিনি অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ন্যাচারাল রিসোর্সেস লিমিটেড কোম্পানিতে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্রামে কৃষিকাজের পাশাপাশি ঢাকায় বায়িং হাউজের ব্যবসা করছেন। এছাড়া গ্রামের আট-দশটি মানুষের মতো যাবতীয় কাজ সে করতে পারে। ভারতে হঠাৎ করে আমার সঙ্গে হোগলের পরিচয় হয়। তার সরলতা আমাকে মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে তার প্রতি আমার আস্থা জন্মেছে। আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।
রহিমা খাতুন বলেন, ক্রিস্ট মার্ক হোগল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। পরে মুসলমান হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে সে। সেই অনুযায়ী মুসলমান হয়। তার বর্তমান নাম ক্রিস্ট মার্ক হোগল ওরফে আয়ুব হোসেন। বাঙালি রীতি মেনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। মেহেরপুরে এই বাড়িটির কাজ শেষ হলে আমেরিকা থেকে ক্রিস্ট মার্ক তার মা ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসবেন এখানে।
তিনি বলেন, হোগলকে নিয়ে আমি সত্যই আমি আনন্দিত। আমার ছেলে-পুত্রবধূ ও মেয়েরা আমাদের মেনে নিয়েছে। ভাষাগত কিছু সমস্যা থাকলেও পরিবারের সদস্যদের সবকিছুই মানিয়ে নিচ্ছেন তিনি। পড়ছেন বাঙালি পোশাকও। আমরা ভালো আছি। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
বহুদেশ ঘুরেছেন ক্রিস্ট মার্ক হোগল ওরফে আয়ুব হোসেন। তবে বাংলার সবুজ প্রকৃতি, ধানক্ষেত ও সরিষা ফুলের হলুদ রং তাকে বিমোহিত করে বারংবার বলে তিনি জানিয়েছেন। বাকিটা জীবন রহিমার সঙ্গেই এদেশে থাকতে চান তিনি।
ক্রিস্ট মার্ক হোগল ওরফে আয়ুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিশিগান খুব সুন্দর শহর। অনেক আগে আমেরিকান স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। রহিমা খাতুন যখন জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই শহরে ছিল; তখনই সেখানে আমাদের পরিচয় ঘটে। সেই সঙ্গে হিন্দিতে দু-এক লাইন কথা বলার পর তারা আবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবে ৬ মাস পর তারা বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন।
তিনি আরও বলেন, বিয়ের ৩ বছর পর কর্মসূত্রে ক্রিস হোগল স্ত্রী রহিমাকে নিয়ে চীনে যান। সেখানে পাঁচ বছর ছিলেন। এরপর তারা কেশবপুরের মেহেরপুরে রহিমা খাতুনের বাবার ভিটায় ফিরে আসেন। সেখানে বাংলার প্রকৃতিকে ভালোবেসে কৃষি ও মৎস্য চাষ শুরু করি। বাংলাদেশের প্রকৃতির সঙ্গে তিনি খাপ খেয়ে নিতে পেরেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, মানুষের জীবন একটা। জীবনের সঙ্গীও একটা হওয়া উচিত। আমি বিশ্বাস করি, রহিমা আমার জীবনে একমাত্র সঙ্গী হয়ে থাকবেন। ওকে পেয়ে আমি দারুণ খুশি। স্ত্রীকে নিয়ে বলেন, ‘ও আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি ওর সঙ্গে সারা জীবন থাকতে চাই।’
রহিমার চাচাতো ভাই আব্দুর রহমান বলেন, শিক্ষিত ও ভিনদেশি মানুষ হয়েও গ্রামের সাধারণ মানুষের মতো ক্রিস হোগল সব কাজ করতে পারে। আমার আপা ও দুলাভাই মেহেরপুরে ফিরে আসার পর রহিমার বাবা আবুল খাঁ মারা যান। রহিমার মা নেছারুন নেছা এখনও জীবিত। রহিমার প্রথম স্বামীর তিনটি সন্তান তাদের সঙ্গে থাকে। সব মিলিয়ে তারা ভালো আছেন।
তিনি আরও বলেন, ক্রিস হোগলের শখ বই পড়া ও মোটরসাইকেলে ভ্রমণ। বর্তমানে একটি সুন্দর পরিবার পেয়ে তিনি সুখী। তার পরিকল্পনা মেহেরপুরে তিনি একটি কৃষি ফার্ম তৈরি করতে চান। সেখানে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেই লক্ষ্যে সবার সহযোগিতা চান তিনি।
বাবার ভালোবাসা ও বটবৃক্ষের মত ছায়া পেয়ে খুশি রহিমার সন্তানরা। বাবার সবকিছুই ভালো লাগে বলে জানান রহিমার বড় ছেলে ইউসুফ হোগল।
তিনি বলেন, ‘বাবা খুব ভালো। আমাদের আপন করে নিয়েছেন। আমরা গরিব, শিক্ষিতও না। কিন্তু এ নিয়ে বাবার কোনো কষ্ট নেই। প্রথমে ভাষা নিয়ে সমস্যা হলেও বাড়ির সবাই এখন ইংরেজি বলতে পারি। তাছাড়া বাবাও বাংলা বুঝতে পারে।’
আরশাদ আলী নামে এক প্রতিবেশী বলেন, বিদেশি মানুষটি এখানে বিয়ে করে অনেকদিন ধরে বসবাস করছেন। তার ব্যবহার ও চলাফেরা খুবই ভালো। সবার সঙ্গে কথা বলে। এখানে এসে প্রায় ১০-১২ বিঘা ফসলি জমি ক্রয় করেছেন। ‘ক্রিস হোগল ধানক্ষেত কাজ করতে পারে। মাটি কাটতে পারে। গরু ছাগলকে খড় কেটে খাওয়াতে পারে।
এমএসআর